সংগৃহীত
![](https://static.wixstatic.com/media/c9f588_34efac7d123443fcb5db42e8a549374c~mv2.jpeg/v1/fill/w_640,h_366,al_c,q_80,enc_avif,quality_auto/c9f588_34efac7d123443fcb5db42e8a549374c~mv2.jpeg)
১) আদিকথা
বাড়িতেই বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক আসতেন-তাঁদের কাছেই পড়তে বসতেন বালক রবি। পাশাপাশি চলত ছবি আঁকা, সঙ্গীত এবং শারীরশিক্ষাও। এমনকি সেই সময়ের বিখ্যাত কুস্তীগির হিরা সিংয়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ কুস্তিবিদ্যা শিখেছিলেন। ঘুম ছিল খুব কম। গভীর রাতে ঘুমাতেন, উঠতেন শেষ রাতে। ভাই-বোনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সবার ছোট। তাঁর পড়াশোনার দায়িত্ব নেন তার বড় ভাই হেমেন্দ্রনাথ। তিনি রবীন্দ্রনাথকে জুডো, জিমন্যাস্টিক এবং কুস্তিও শেখাতেন। প্রথাগত শিক্ষার প্রতি উদাসীন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে মাত্র এক দিন স্থানীয় প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়েছিলেন।
২) রবীন্দ্রনাথের রুটিন
দিন শুরু হতো ভোর ৪টায়। স্নান করে পূজা করতেন। তারপর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত একটানা লিখতেন। সকাল ৭টায় প্রাতঃরাশ সেরে আবার লেখা। ফাঁকে ফাঁকে চলত চা বা কফি পান। বেলা ১১টা পর্যন্ত লিখে আবার স্নান করতেন। তারপর দুপুরের খাওয়া। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম বা ঘুম তাঁর ধাতে ছিল না। পত্রিকা বা বইয়ের পাতা উল্টিয়ে সময় কাটিয়ে দিতেন। বিকেল ৪ টেয় চা, সঙ্গে নোনতা কিছু। রাতের খাবার খেতেন সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে। এ সময় তিনি ইংরেজি খাবার পছন্দ করতেন। অথচ দুপুরে খেতেন বাঙালি খাবার। রাতে খাবার পর একটানা রাত ১২টা পর্যন্ত লিখতেন বা পড়তেন। এই ছিল তাঁর নিত্য রুটিন।
৩) রবীন্দ্রনাথের পোশাক
বাড়িতে পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা। উপাসনা বা সভা সমিতিতে যাওয়ার সময় জোব্বা ছাড়াও সাদা ধুতি, জামা ও চাদর ব্যবহার করতেন। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমী উত্তরীয় নেওয়া ছিল তাঁর শখ। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি, বসন্তে বাসন্তী। আবার জোব্বার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে উত্তরীয় নিতেন অনেক সময়।
৪) বৃক্ষপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ
বৃক্ষপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য উদ্ভিদ আর ফুলের নাম। শুধু কাব্যেই উল্লেখ রয়েছে ১০৮ গাছ ও ফুলের নাম। এর মধ্যে বেশ কিছু বিদেশি ফুলের বাংলা নাম তিনি দিয়েছিলেন। অগ্নিশিখা, তারাঝরা, নীলমণিলতা, বনপুলক, বাসন্তী এগুলি তাঁরই দেওয়া নাম। ভানুসিংহ ঠাকুর যে রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম সেটা অনেকেরই জানা। তার আরো কয়েকটি ছদ্মনাম ছিল। যেমন দিকশূন্য ভট্টাচার্য, অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালী, পাকড়াশি ইত্যাদি।
৫) কবি রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তাঁর প্রথম বই ‘কবি কাহিনী’ প্রকাশিত হয় কবির অজান্তে ১৮৭৮ সালের ৫ নভেম্বর। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে। কবিবন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ বইটি প্রকাশ করে কবির কাছে পাঠিয়ে দেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কবিগুরুর মোট ৩১১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ থেকে প্রকাশিত ৮৮টি গ্রন্থ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ একবার হিসাব করে দেখেছিলেন, গল্পগুচ্ছসহ রবীন্দ্রনাথের ১৮টি গ্রন্থে মোট ৮,৬৩,৩১০টি শব্দ আছে। তার মধ্যে ‘আমি’ আছে ৭,৭৩৭ বার এবং ‘তুমি’ আছে ৩,১৪৭ বার। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৭ সালে ১৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
৬) রবীন্দ্রনাথের গান
গবেষকদের মতে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম গান হচ্ছে তার খুড়তুতো দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম আননে’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত। এখন রবি ঠাকুরের গান বলতে তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান। অথচ রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে রবি ঠাকুরের গান বলতে বোঝান হত তাঁর গাওয়া গান। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গানের সংকলন প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। ‘গীতবিতান’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। ঠাকুর পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের লোক, যিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে গান শিখে বিভিন্ন জায়গান গান গেয়েছেন এবং পরে রেকর্ড করেছেন তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী অমলা দাশ। রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম ডিস্ক বেরোয় ১৯০৫ সালে। একপিঠে ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ অন্যপিঠে স্বরচিত ‘সোনার তরী’ কবিতার আবৃত্তি। রেকর্ডে প্রথম ‘রবীন্দ্রসংগীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল কনক দাশের গাওয়া ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত একটি রেকর্ডে। পূর্বে রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে লেখা হতো ‘রবীন্দ্রগীতি’ বা কখনও ‘কথা ও সুর : রবীন্দ্রনাথ’ কিংবা কেবলমাত্র বন্ধনীর মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ’ অথবা ‘আধুনিক’।
১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চস্থ করেন ‘নটীর পূজা’। নিউ থিয়েটার্স সেই অভিনয়ের সবাক চিত্র তুলে রাখে। ‘নটীর পূজা’ প্রথম মুক্তি পায় চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে ১৯৩২ সালের ২২ মার্চ। নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনিচিত্রের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্ররূপ ‘মানভঞ্জন’ মুক্তিলাভ করে ১৯২৩ সালে। রবীন্দ্র-কাহিনিভিত্তিক প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নাম `চিরকুমার সভা`। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ছবিটি পরিচালনা করেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। ছবিটি ১৯৩২ সালের ২৮ মে চিত্রায় মুক্তি পায়।
রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নয় এমন চলচ্চিত্রে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয় প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবিতে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। পঙ্কজকুমার মল্লিকের সংগীত পরিচালনায় ছবিটিতে কানন দেবীর কণ্ঠে দুটি এবং পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে দুটি মোট চারটি রবীন্দ্রসংগীত স্থান পেয়েছিল।
৭) রবীন্দ্রনাথের অভিনয়
রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন ১৮৭৭ সালে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘এমন কর্ম আর করব না’ নাটকে। নাটকে তিনি অলীকবাবুর ভূমিকায় মঞ্চে উঠেছিলেন। তখন তার বয়স ১৬ বছর। নিজের লেখা নাটকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন ‘বাল্মিকী প্রতিভা’য় বাল্মিকীর ভূমিকায়। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় জোড়াসাঁকোয় ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। অভিনয়ের জন্যে রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চে মোট ১০১ বার উঠতে হয়েছিল। তার অভিনয় দেখে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথই দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।’
৮) রবীন্দ্রনাথের বল ডান্স
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও কবিগুরু চমৎকার ‘বল ডান্স’ করতে পারতেন। শিখেছিলেন খুড়তুতো দিদি সত্যেন্দ্রবালা ঠাকুরের কাছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর নৃত্যশৈলীকে বলতেন ‘ভাবনৃত্য’। জাভা দেশের নৃত্যের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ থেকে এই শৈলীর জন্ম। মণিপুরি, কথাকলি, ভরতনাট্টম, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিনাচ, জাভার নৃত্যভঙ্গি- নানা দেশের নানা ধরনের নৃত্যশৈলী দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি নিজস্ব নৃত্যশৈলীর জন্ম দিয়েছিলেন। তবে তিনি সবসময় বলতেন, ‘নাচের টেকনিক যেন গানের ভাবকে ছাড়িয়ে না যায়।’
৯) রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল মনের সঙ্গে সঙ্গে ছিল একটি ভ্রমণপিপাসু মনও। তিনি বিশ্বের ৫টি মহাদেশের ৩০টি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯ শতকের শেষ এবং ২০ শতকের গোড়া এই সময়টুকুর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সুবৃহৎ ভ্রমণপর্বটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অংশে তো একাধিক বার তিনি ভ্রমণ করেছেন।
১০) রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি
শুরুতে বিক্ষিপ্তভাবে আঁকলেও রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ছবি আঁকতে শুরু করেন ১৯২৮ সালে। তখন তার বয়স ৬৭ বছর। ১৯০১ থেকে ১৯৪০ এ সময় তিনি এঁকেছিলেন প্রায় তিন হাজার ছবি। শান্তিনিকেতনের বাইরে তার ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় ফ্রান্সের প্যারিসে ১৯৩০ সালে। প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। দেশ বিদেশের বহু শিল্পী রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছবি আঁকেন তার দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সময়টা তখন ১৮৮১ সাল।
১১) রবীন্দ্রনাথের নোবেল
সকলেই জানেন যে রবীন্দ্রনাথ হলেন প্রথম বাঙালি যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই এটি জানেন না যে, নোবেলবিজয়ী কবি কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে নোবেল নেননি। প্রথমে তাঁর হয়ে ব্রিটিশ অ্যাম্বাসাডর ‘নোবেল’ গ্রহণ করেছিলেন। পরে তা কবিকে হস্তান্তরিত করা হয়।
১২) ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ হিমালয়ে অবকাশ কাটাতে ভালোবাসতেন। তাঁর হিমালয়ে ভ্রমণের সূত্র তাঁর মেয়ে রেনুকা। রেনুকা টিবি বা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকরা তাঁকে বিশুদ্ধ বাতাসের কোনো যায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তখন রবীন্দ্রনাথ ১৯০৩ সালে রেনুকাকে নিয়ে হিমালয়ের রামগড়ে গমন করেন। সেখানে অবস্থানকালেই তিনি তার ‘শিশু’ শিরোনামের কবিতা সংকলনের জন্য কবিতা লিখেন। রেনুকার অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়লে তিনি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯১৪ সালে রেনুকা মারা গেলে তিনি পুনরায় রামগড়ে পাড়ি জমান। আর এখানে বসেই তিনি ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের কিছু অংশ রচনা করেন। আর এই কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি নোবেল জয় করেন। রামগড়ের যে স্থানে তিনি থাকতেন সেই স্থান এখন ‘টেগোর টপ’ বা ‘ঠাকুর চূড়া’ নামেই পরিচিত।
Comments