ডাঃ অরুণিমা চ্যাটার্জী

রূপম, রীতমের থেকে চার বছরের বড়। যদিও হঠাৎ করে দেখলে রীতমকেই বড় ভাই বলে মনে হবে। রূপম আর রীতম, অভিজিত আর রিম্পার দুই ছেলে -কিন্তু যেন মনে হয় এরা বাস করে পৃথিবীর দুই গোলার্ধে । আপাতদৃষ্টিতে দুজনের মধ্যে চেহারার অনেক মিল থাকলেও, ওদের স্বভাবের অমিল দেখে অভিজিত আর রিম্পাই অবাক হয়ে যায়।
- ছোটবেলা থেকেই রূপম ভীষণ শান্ত যাকে বলে সাত চড়ে রা নেই। রীতম তার পাশাপাশি প্রচণ্ড দুরন্ত তেমন সাহসী এবং স্বাবলম্বী। তাই একটু বড় হবার পর থেকেই রীতমকে নিয়ে রিম্পাকে বেশী চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু ওর একমাত্র চিন্তা ওর ওই গোবেচারা, ভালোমানুষ, বড় ছেলেটাকে নিয়ে!
রূপম এবারে ক্লাস এইটে উঠলো। পড়াশোনায় খারাপ নয়। কিন্তু পরীক্ষা এগিয়ে এলেই রূপমের চেহারার মধ্যে ভীষণ একটা ভীত সন্ত্রস্ত ভাব ফুটে ওঠে। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকেই ওর হাসি কমে যায়- সারাদিন মনমরা হয়ে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। বার বার মাকে জিজ্ঞাসা করে “মা আমি পরীক্ষায় পারব তো? পরীক্ষার হলে আমার যদি কিচ্ছু মনে না পড়ে?” রিম্পা তার ছেলেকে আশ্বস্ত করে, নির্ভয় দেয়, কিন্ত রূপমের মন থেকে চিন্তা, ভয় দূর হবার কোন লক্ষণই দেখা যায় না।
রিম্পা, রূপমকে নিয়ে ওর দুশ্চিন্তার কথা বতবারই অভিজিতকে বলতে গেছে ততবারই সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। হাসতে হাসতে বলেছে “তুমিও কি টেনশন করছ রূপমের মত? ছোটবেলায় অনেকেই পরীক্ষা এলে ভয় পায় একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সমস্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আজকাল ঘুমের মধ্যেও রূপম দু্ঃস্বপ্ন দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, মাঝরাতে চমকে উঠে কেঁদে মাকে জড়িয়ে ধরে। পরীক্ষার দিনগুলোতে রিম্পার মনে হয় ছেলের সাথে যেন সে-ও পরীক্ষা যুদ্ধে অবতীর্ণ । পরীক্ষার এক মাস আগে থেকে রূপমের খাওয়া দাওয়া কমতে শুরু করে যত পরীক্ষা এগিয়ে আসতে থাকে ততই রূপমের রাতের ঘুম কমতে থাকে। মাঝে মাঝে রিম্পার ভয় হয় তার ছেলের যদি পরীক্ষার টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যায়।
ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে রূপমের স্বভাবের বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে রিস্পা বেশ চিন্তিত! রূপম আজকাল মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক থাকে, দেখলে মনে হবে ও যেন কোন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। পড়াশোনাতেও বেশীক্ষণ মন বসাতে পারে না। রিম্পা অনেক জিজ্ঞাসা করেও ছেলের কাছ থেকে কোন সদুত্তর পায় না। এতদিন অভিজিত কোন গুরুত্ব না দিলেও সেদিনের ঘটনার পর থেকে ব্যাপারটাকে নিয়ে না ভেবে ও পারছে না।
সেদিন সোমবার। সপ্তাহের প্রথম দিন। স্বভাবতই যথা সময়ে অভিজিত অফিসে পৌঁছায়। দুপুর ১২টার সময় হঠাৎ মোবাইলে রিম্পার নম্বর ভেসে উঠতে কিছুটা অবাক হয় অভিজিত। কারণ রিম্পা জানে আফসের টিফিন আওয়ার্স ছাড়া অন্য সময়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে অভিজিত। তাই বিশেষ প্রয়োজন না হলে রিম্পা কখনোই অভিজিতকে ফোন করে না। মুহূর্তের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে অভিজিতকে। নানা চিন্তা মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে অভিজিতকে বিভ্রান্ত করে দেয়। কিছুটা হতভম্ব হয়েই ফোন ধরে অভিজিত। বিশেষ কিছুই রিম্পা বলে না অভিজিতকে, বারবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও। রিম্পার গলায় একটা চাপা উত্তেজনা, উদ্বেগ অভিজিতকে আরও ভাবিয়ে তোলে।রিম্পা শুধু অভিজিতকে তক্ষুনি বাড়ি চলে আসার কথা বলে ফোন রেখে দেয় .......
রূপম অন্যদিনের মত সেদিনও স্কুলে গিয়েছিল। পরীক্ষার আর দু’সপ্তাহ বাকী। কিন্তু স্কুলে পৌঁছাবার এক ঘন্টা পরেই রিম্পা স্কুলের হেডমাস্টারের কাছ থেকে ফোন পায় যে বিশেষ দরকারে এক্ষুনি তাকে স্কুলে পৌঁছতে হবে। স্কুলে পৌঁছে রিম্পা দেখে রূপমকে ঘিরে ছোট একটা জটলা, মুহুর্তে ধক্ করে ওঠে রিম্পার বুক, ক্লাসটিচার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে জানা যায় যে তখন দ্বিতীয় পিরিয়ড চলছিল। ক্লাস চলাকালীন হঠাৎ করে রূপম উঠে দাঁড়িয়ে বলে যে, তার শরীর খারাপ লাগছে। ও জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, মুখের রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ক্লাস টিচার ওর কাছ অবধি পৌঁছবার আগে ধীরে ধীরে ও শরীর এলিয়ে দেয় বেঞ্চে। ওর হাত, পা ঠাণ্ডা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ক্লাসটিচার ছুটে যান হেডস্যারের ঘরে। যখন হেডস্যারকে নিয়ে ফিরে আসেন, ততক্ষণে রূপম চোখ খুলে তাকিয়েছে। ইতিমধ্যে রিম্পা এসে পৌঁছয় স্কুলে। বাড়ি এনে রূপমকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। রিম্পা এখনও অবধি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ঘটনার আকস্মিকতা ওকে কেমন হতবুদ্ধি করে দিয়েছে।কলিংবেলের শব্দে চমক ভাঙে রিম্পার।
অভিজিতকে দেখে এতক্ষণ চেপে রাখা মনের অসহায়তা আর বাঁধ মানে না- কেঁদে ফেলে রিম্পা।সবকিছু শুনে অভিজিতও রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান আপাততঃ সব দেখেশুনে বলেনমনে হয় এটা ভেসোভেগাল সিন্কোপ (Vasovagal Syncope) অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ হয়ত খাওয়া-দাওয়া করেনি বা স্কুলে প্রেয়ারের সময় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তাই ক্লাসে এসে মাথা ঘুরে যায়। উনি আশ্বাস দেন যে বিশেষ ভয় পাবার কিছু নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওরা দুজনে। রূপমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রিম্পা সারাদিন তার মনের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে সে কথা চিন্তা করতে থাকে। হঠাৎ রূপমের দিকে চোখ পড়ে রিম্পার।রূপমের চোখে জল। মায়ের সাথে চোখাচোখি হতে রূপম ফুঁপিয়ে কেদে বলে ওঠে, “মা আমার ভীষণ ভয় করছে আমি যদি মরে যাই,” ছেলেকে আশ্বস্ত করতে করতে ছেলের অলক্ষ্যে চোখ মোছে রিম্পা।নিজেকে এতটা অসহায় ওর কখনো মনে হয়নি। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী হার্টের যাবতীয় পরীক্ষা করা হয় রূপমের কিন্তু কোন রিপোর্টেই কিছু পাওয়া যায় না।
রক্ত পরীক্ষার রি্পোর্টটাও স্বাভাবিক। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই একদিন সকালে হঠাৎ করে আবার এ রকম হয় রূপমের। এবারে রিম্পা কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা লক্ষ্য করে। আর পাঁচটা দিনের মতই রিম্পা ব্যস্ত ছিল রান্নাঘরে। ব্রেকফাস্টের পর্ব মিটেছে, এখন অভিজিত অফিস বেরোবে। হঠাৎ করে পড়ার ঘর থেকে রূপমের ডাকে রিম্পা ছুটে যায় সেখানে। রিম্পা কাছে গিয়ে দেখে ওর চোখে মুখে একটা ভয়ার্ত ভাব, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, হাতদুটো মৃদু কাঁপছে। হাত দুটো বরফের মত ঠাণ্ডা, মুখ চোখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রূপমের। রিম্পা হতবুদ্ধি হয়ে স্থাণুর মত দাড়িয়ে থাকে, কি করতে হবে বুঝতে পারে না। কয়েকমুহুর্ত পর রূপম আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যেতে থাকে। ধড়ে প্রাণ ফিরে পায় রিম্পা। বার বার প্রশ্ন করেও রিম্পা বুঝতে পারে না রূপমের সমস্যাটা।রূপম বলতে থাকে হঠাৎ করে ওর বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে, গলা শুকিয়ে যায়, হাত পা কাঁপতে শুরু করে আর ভয় হয় এক্ষুনি বুঝি মরে যাবে। আবার চলে একপ্রস্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিন্তু এবারেও সমস্ত রির্পোট নেগেটিভ!
অভিজিত আজকাল হঠাৎ করে ভীষণ রেগে যায় রিম্পার উপর, বিশেষ কোন কারণ ছাড়াই, রিম্পা বুঝতে পারে ছেলেকে নিয়ে দিবারাত্র চিন্তা করতে করতে দিশাহারা অভিজিত। ভীষণ অসহায় মনে হয় রিম্পার নিজেকে। অসহায়তা ধীরে ধীরে হতাশায় রূপান্তরিত হতে থাকে।
দু'সপ্তাহ পরের ক্লাস টেস্টটা রূপম দিতে পারে না। মেডিকেল সার্টিফিকেট থাকায় আপাততঃ কোন অসুবিধা হয় নি। কিন্ত মাঝে মাঝেই রূপমের এ রকম আ্যাটাক হতে থাকে। মাসে চার পাঁচ বার তো বটেই।
এইভাবে আরও ছয়মাস কেটে গেছে। রূপমের অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে । আজকাল ও বাড়ির বাইরে কোথাও যায় না। প্রতি মুহুর্তে ওর একটাই ভয় আবার যদি এ রকম হয়? তখন ওকে কে বাঁচাবে? হাজার বার বুঝিয়েও অভিজিত বা রিম্পা কেউই ওকে আশ্বস্ত করতে পারে না। এমনকি বাড়ির সামনে খেলার মাঠে পর্যন্ত যাওয়া রূপম ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিতে পারে না ও। নিরন্তর ওই একটাই ভয় আর দুশ্চিন্তা ওকে গ্রাস করে থাকে। রূপমকে আগের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে বাড়ির কাছেরই একটা ছোট স্কুলে ভর্তি করতে হয়েছে। রিম্পাকে সংগে করে নিয়ে যেতে হয় ওকে এবং সারাদিন স্কুলে বসে থাকতে হয়। ক্লাসের বাইরে গেলেই মাকে পাওয়া যাবে এই আশ্বাস আছে বলেই রূপম রাজী হয়েছে স্কুলে আসতে। তা না হলে ওকে আর স্কুলে আনাও সম্ভব হচ্ছিল না। একা একা স্কুলের বাইরে গাছতলায় বসে অপেক্ষা করতে হয় রিম্পাকে, কখন স্কুল ছুটি হবে। বসে থাকতে থাকতে নানা চিন্তার স্রোতে ভেসে যেতে থাকে রিম্পা। মনের অসহায়তা আর হতাশা দু’চোখ বেয়ে অঝোরে নেমে আসতে থাকে। রিম্পা ভাবতে থাকে, এ এক অন্য রূপম যার সাথে কোন মিল নেই আগের রূপমের। একটাই চিন্তা বারবার কষাঘাত করতে থাকে মনের দরজায় “রূপম কি কখনো আবার স্বাভাবিক হতে পারবে?”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞর অভিমতঃ
রূপম যে সমস্যায় ভুগছে মনোরোগের ভাষায় তাকে প্যানিক ডিসঅরডার উইথ এগোরাফোবিয়া বলা হয় (Panic disorder with agoraphobia). এই অসুখের অন্যতম লক্ষণ হল প্যানিক আ্যাটাক (Panic attack)। এতে হঠাৎ করে (out of the blue) শরীরের মধ্যে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ হয় ( intense fear or discomfort)। এতে হঠাৎ করে বুক ধড়ফড় করা (palpitation), ঘাম হওয়া (sweating), হাত-পা কাঁপা (Trembling or shaking), দম বন্ধ ভাব (shortness of breath or feeling chocking ), বুকের মধ্যে যন্ত্রণা বা অস্বস্তি (chest pain or discomfort), পেটে অস্বস্তি বা বমি ভাব (abdominal distress or nausea), মাথা ঘোরা (dizziness), এক্ষুনি মরে যাব বা পাগল হয়ে যাব মনে হওয়া (fear of impending doom or going crazy), হাত-পা ঝিনঝিন করা (numbness or tingling sensation), সারা শরীর ঠাণ্ডা অথবা গরম হওয়া (chills or hot flushes) - এই লক্ষণগুলো দেখা যায়। এই প্যানিক অ্যাটাক কয়েক সেকেন্ড থেকে বেশ কয়েক মিনিট পর্যন্ত থাকতে পারে। একবার বা দুবার এরকম হবার পর রোগীর সবসময় ভয় হতে থাকে আবার কখন এরকম হবে (Anticipatory anxiety)। অসুখ যত এগোতে থাকে প্যানিক অ্যাটাকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে (Recurrent unexpected panic attacks)। রোগীর Anticipatory anxiety বা আবার অ্যাটাক হওয়ার চিন্তাও ততই বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জনজীবন এবং বাইরের কাজ থেকে সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। ধীরে ধীরে সে ঘরের বাইরে বেরোতে ভয় পেতে শুরু করে কারণ প্রতি মুহুর্তে মনে হয় যে বাইরে বেরোলেই যদি অ্যাটাক হয় তখন আমাকে কে দেখবে? অসুখ যত বাড়তে থাকে রোগী তত বাইরে যেখানে ভীড় হওয়ার সম্ভবনা সেই সমস্ত স্থানে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে বেরোনোই বন্ধ হয়ে যায়। এই অসুখকে বলা হয় এগোরাফোবিয়া (Agoraphobia)।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে যে তাহলে রূপমের মত এই অসুখে আক্রান্তদের কি ভবিষ্যত? সৌভাগ্যের বিষয় একটাই যে মনোবিজ্ঞানের (Psychiatry) মাধ্যমে এর নিরাময় সম্ভব।
অসুখের তীব্রতা (severity) অনুযায়ী রোগীকে ওষুধের মাধ্যমে (Pharmacotherapy) এবং অথবা সাইকোলজিকাল চিকিৎসার (Psychotherapy) মাধ্যমে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।
তাই রিম্পা এবং অভিজিতের মত এই অসুখের আক্রান্তদের পরিবারের হতাশায় ভেঙে পড়ার কোন কারণ নেই। সবচেয়ে বেশী যেটা জরুরী সেটা হল এই অসুখ সম্বন্ধে সম্যকজ্ঞান (awareness and timely intervention) এবং সময়মত চিকিৎসা শুরু করা।

লেখিকা পরিচিতি
লেখিকা বিশিষ্ট স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবীক্ষণ।
コメント