top of page

শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ

ডঃ অতসী সরকার


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যখন “শান্তিনিকেতন” আশ্রম তৈরি করেন তখন এই মাঠ ছিল রায়পুরের সিংহ পরিবার-এর জমিদারদের। এই জায়গাকে কেন্দ্র করে কয়েক বিঘা জমি তিনি কিনে নিয়েছিলেন।রায়পুরের সিংহ পরিবার, বিশেষত সেই পরিবারের শ্রীকণ্ঠ সিংহ মহর্ষির একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন। সে জায়গা কিন্ত নির্জন প্রান্তর তাও বলা যায়না |

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে এখানে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

নির্জন প্রান্তরে এখানে দুটি ছাতিম গাছ ছিল। শান্তিনিকেতনের দক্ষিন দিকে একটি জলাশয় ছিল তারই ধারে ভূবনভাঙ্গা গ্রাম এবং সেখানে তখন থাকতো ডাকাতের দল। শোনা যায় যে ডাকাতেরা মহর্ষির প্রভাবে সেই ডাকাতি ছেড়ে কৃষিকার্য শুরু করে।

সেকালের সেই ছাতিম গাছ দুটি আর নেই। এ জায়গায় অন্য ছাতিম গাছ রোপণ করা হয়। সেটি “ছাতিম তলা “ নামে পরিচিত। সেই “ছাতিম তলার দক্ষিণ দিকের গেটে “তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি” এই কথাটি লেখা আছে।

১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। ১৯৫১ সালে সেটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়।

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের শেষ ভাগের বেশি সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমে কাতিয়েছেন। তার সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মে এই আশ্রম ও আশ্রম-সংলগ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি সমুজ্জ্বল।

শান্তিনিকেতন চত্বরে নিজের ও অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ বিশেষ স্থাপত্যসৌকর্যমণ্ডিত একাধিক ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন। এখন আশ্রমনিবাসী বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের সৃষ্টিকর্মে সন্জিত হয়ে এই আশ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল হয়ে উঠেছে।

সেই ছাতিম গাছের পাশেই একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করা হয় সেটি শান্তিনিকৈতনের আদি বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৮৬৪ সালে এই দালান বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন। প্রথমে একতলা ছিল। পরে দোতলা হয়। বাড়ির উপরিভাগ লেখা আছে, সত্যাজ্র এাণারামং মন ত আনন্দং -- মহর্ষির প্রিয় উপনিষদের উক্তি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে ক্লাস নিতেন, এখানে কিছুদিন বাসও করেছিলেন। তখন এর সামনে একটি পুকুর ছিল। পুকুরের পাশেই একটি উঁচু মাটির টিবি আছে। মহর্ষি এখানে

ধ্যানে বসতেন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন। পাশেই, ১৮৯২ সালে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত রঙ্গিনকাঁচ দিয়ে তৈরি উপাসনা মন্দির বা কাচের মন্দির। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে প্রতি বুধবার সকালে উপাসনা হয়।

তেজশচন্দ্র সেন নামক এক বৃক্ষপ্রেমী একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে একটি বাড়ি তৈরি করেন কাচের মন্দিরের সামনে | তাল গাছের পাতাগুলি 'ধ্বজা'র মত করে বাড়িটির উপরে শোভিত বলেই এই বাড়ির নাম "তালধ্বজ"।

কাচের মন্দির-এর পাশে “আম্রকুঞ্জ”। মহারাজা মহতাব চাঁদ তার মালি রামদাসকে পাঠিয়ে এই বাগানের পত্তন করেছিলেন। এর সামনে শাল বীথি, ঘণ্টাতলা, গৌরপ্রাঙ্গণ ইত্যাদি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ স্মরণে পৌষ উৎসব শুরু হয়। একন পরিবর্তিত রূপ ও উৎসব পৌষ মেলা ।

১৯০৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, বসন্তপঞ্চমীতে, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে, যে খতু উৎসবের সূচনা হয, তারই পরিবর্তিত রূপ ব্রত্মানের বসন্ত উৎ্সব। এখানে ২টি রেলস্টেশন রয়েছে। বোলপুর শান্তিনিকেতন ও প্রান্তিক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। এজন্য শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রকৃতির মধ্যে গাছের তলায় শিক্ষা দেওয়ার প্রথা চালু আছে। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে পাশাপাশি গ্রাম ও তার মানুষদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

শান্তিনিকেতনে শীতকালে বা গ্রীষ্মকালে বরাবরই দুই প্রকারের ভীষণ জলকষ্ট ছিল।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের সীমিত আর্থিক সঙ্গতি দিয়ে মাত্র পাঁচজন ছেলে নিয়ে যে বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলেন, শুরুতে এর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অলংকার বিক্রি করেছিলেন।পুরীর বাংলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পিতার শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট থেকে বছরে আঠারশ টাকার উপরই তিনি প্রধানত নির্ভর করতেন। পরে তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ ক্ষুলে লাগিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে তাঁর বাংলা গ্রন্থাবলির গ্রন্থস্বত্ব বিশ্বভারতীকে দান করেন। প্রাথমিক অবস্থায় অতি অল্প বেভনের শিক্ষকদের কাছ থেকেও সাহায্য এসেছিল। ইংল্যান্ডের ডব্লিউ ডব্লিউ পিয়ার্সন এবং সি.এফ এন্ডুজ তাঁদের সর্বস্ব স্কুলে দান করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডরোথি এমহার্স্ট স্ট্রেইট এবং ইংল্যান্ডের লিওনার্ড এমহার্স্ট শ্রীনিকেতনের উন্নয়নের জন্য নিয়মিত আয়ের উৎসরূপে তাঁদের ডার্টিংটন হল ট্রাস্ট থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দান করেছিলেন। ত্রিপুরা, বরোদা,জয়পুর্, সিখপুরম, কাখিযাওযাড়, পোরবন্দর, লিমডি, আওযাগড় হায়দ্রাবাদের রাজপরিবার এবং স্যার রতন টাটা শান্তিনিকেতনে প্রচুর দান করেছিলেন।

ছিল প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা ও পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান এবং বৃহত্তর জগতকে নিজের মধ্যে গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য গড়ে তোলা।

নিজের মতো করে হাতেকলমে করে গড়ে তোলার জন্য ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। সেখানে ছিল নানাবিধ গ্রামীণ সেলা, গ্রামীণ উৎসব, গ্রামীণ যোগাযোগ। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা হয়ে উঠেছিল মানবতা বোধের শিক্ষা।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের ধারণা শুধু বাংলা বা ভারতে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।


লেখিকা পরিচিতি

ডঃ অতসী সরকার, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page