top of page

রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান নারী সমাজ

শালিনী ভট্টাচার্য




রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেহ নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা?' কবিগুরু

বারবার তাঁর লেখনীর দ্বারা মেয়েদের জন্য শুধু নারীত্বের নয় মানুষের অধিকার দাবী করেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাভাবনা ও মানসিকতায় সমকালীন যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তিনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বাধীনতায়, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে।তাই রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসের বহু নারী সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কখনো সোচ্চারে কখনো নিরুচ্চারে। কখনো বা নিজের ইচ্ছা, নিজের অনুভূতিকে মর্যাদা দিতে গিয়ে তারা সামাজিক নিষেধের বেড়াজালকে অতিক্রম করেছে অনায়াসে।

রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসের এলা, বিমলা, চারুলতা, কুমুদিনী , লাবণ্য, সোহিনী - এরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিত্বময়ী, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে সক্ষম।

কিন্তু বাস্তববাদী রবীন্দ্রনাথ এটাও জানতেন যে ভারতীয় সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারী মুক্তি ঘটতে অনেক সময় লাগবে। আবার বিশ্বকবি বিশ্বের বহু দেশে যে নারী জাগরণের চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন সে সম্বন্ধে তাঁর 'নারী 'প্রবন্ধে লেখেন, ' এ দিকে প্রায় সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার কারণ সর্বত্র সীমানা ভাঙার যুগ এসে পড়েছে।' ঠাকুরবাড়ির কন্যা এবং বধূরা অধিকাংশই ছিলেন এই সীমানা ভাঙার দলে - স্বাধীন, মুক্তমনা,প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ তাদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের সহায়ক ছিল।রবীন্দ্রনাথের বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে গর্ভবতী অবস্থায় তার তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই একাকী পাড়ি দেন বিলেতের অভিমুখে। আর একবার স্বামী অসুস্থ থাকায় একাই লাটভবনে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন। ঠাকুর বাড়ির কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন স্বনামধন্য লেখিকা।সেকালে তার 'সখি সমিতি ' নারীর উন্নতির জন্য কাজ করতো।স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা বিদুষী সরলাকুমারী দেবীর প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে নিবিড় যোগ ছিল। তিনি 'ভারত স্ত্রী মহামন্ডল ' প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের সাথে তার একাধিক বিষয়ে মতবিরোধও হয়েছিল। কিন্তু ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের সামাজিক অবস্থান ও তৎকালীন নারীসমাজের সামগ্রিক অবস্থানে আকাশ পাতাল পার্থক্য ছিলো। তখনকার নারীদের দাবী কবিকন্ঠে ধ্বনিত হয়,যখন তিনি প্রশ্ন করেন 'কেন শূণ্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে সার্থকের পথ?' নারীর সার্থকতা যে কেবল ঘরকন্না বা সন্তান ধারনে নয় একথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন বলেই স্ত্রীর পত্রের 'মৃণাল' চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। যিনি বিবাহিত জীবনের পনেরো বছর পর সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করেন যে জগৎ ও জগদীশ্বরের সাথে তার অন্য সম্বন্ধও আছে। যখন কবি লেখেন 'বাইশ বছর রয়েছি সেই এক চাকাতেই বাঁধা/ পাকের ঘোরে আঁধা/ জানি নাই তো আমি যে কী, জানি নাই এ বৃহৎ বসুন্ধরা/ কী অর্থে যে ভরা!' তখন সেটি কেবল এক গৃহবধূর উপলব্ধি থাকে না তা তৎকালীন রমণীকুলের বক্তব্য হয়ে ওঠে।


রবীন্দ্রনাথ ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেন নি, দেখে যেতে পারেননি শত প্রতিকূলতাকে জয় করে তাঁর দেশের মেয়েদের ক্রম অগ্রসরের কাহিনিকে। কিন্তু দূরদর্শী কবি জানতেন ' পৃথিবীতে নতুন যুগ এসেছে। আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মেয়েরা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন এই বৃহৎ সংসারের দায়িত্ব তাদের স্বীকার করতেই হবে,নইলে তাদের লজ্জা, তাদের অকৃতার্থতা।'('নারী'/ রবীন্দ্রনাথ) ভারতের মেয়েদের বৃহৎ সংসার সামলানোর অনায়াস দক্ষতার তিনি প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হতে পারেন নি।যে স্বাধীন নারীর স্বপ্ন তিনি দেখতেন বাংলা তথা ভারতের মেয়েরা অনেকাংশেই তাঁর সেই স্বপ্নকে সফল করতে সক্ষম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'নারী' প্রবন্ধে লিখেছিলেন ' নবযুগের আহ্বান আমাদের মেয়েদের মনে যদি পৌঁছে থাকে তবে তাঁদের রক্ষণশীল মন যেন বহু যুগের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাকে একান্ত আসক্তির সাথে বুকে চেপে না ধরে । তাঁরা যেন মুক্ত করেন হৃদয়কে ,উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়।...সামনে আসছে নতুন সৃষ্টির যুগ।' বর্তমান মেয়েদের শৃঙ্খল মোচন মূলত ঘটেছে শিক্ষার প্রসারের ফলে। পরাধীন ভারতের ন্যায় জাত পাতের সমস্যা, নারী নির্যাতন, বধূহত্যা, খুন, ধর্ষণ সবই আছে স্বাধীন ভারতে। কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে ভারতের অধিকাংশ মেয়েদের মানসিকতার। তারা আর নিজেদের অবলা, পুরুষের কৃপার পাত্রী মনে করেনা। তারা সর্বক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে চায়। খেলার জগত থেকে সেনাবাহিনীর অন্দর- সর্বত্র ভারতের মেয়েদের অবাধ বিচরণ। প্রত্যন্ত গ্রামের নাবালিকা মেয়েটিও আজ প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে নিজের বিবাহ ভেঙে দিতে সক্ষম। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়- এই বিশ্বাস ভারতের বেশিরভাগ নারীর মধ্যে চারিত হয়েছে। আর তাই বর্তমানে কোনো পেশাই আর পুরুষের একচেটিয়া নয়। সর্বত্র মেয়েদের প্রবেশ ঘটছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে গোটা পৃথিবীর খবরই আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের একটি সফল মেয়ের কাহিনি টেলিভিশন, ফোনের মাধ্যমে পৌঁছে যায় দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের কাছে। মেয়েদের ক্রমাগত অগ্রসর হওয়ার এই কাহিনি একটি অত্যন্ত সাধারণ মানুষকেও বিশ্বাস করতে শেখায় যে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি শুধু তার ছেলে নয় তার মেয়েটিও করতে সক্ষম। একদিকে ক্রমাগত বাড়তে থাকা জীবন ধারনের ব্যয়, অন্যদিকে প্রায় সব পেশাতেই মেয়েদের সাফল্যের জয়গাথা- ভারতের বহু মানুষের রক্ষণশীল মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে। স্বাধীন ভারত মেয়েদের সুরক্ষা সর্ব ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু মেয়েদের সামাজিক মর্যাদার বিপুল বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের' হৃদয়ের সৌন্দর্যে '

বিশ্বাস করতেন। মেয়েরা তাদের কল্যাণকামী সত্তাকে বিসর্জন না দিয়েই ঘরে বাইরে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম - কবির

এই প্রতীতিকে মেয়েরা অনেকাংশেই সত্যে পরিণত করেছে, আর এটাই ভারত তথা বাংলার নারীদের তাদের প্রাণের কবিকে দেওয়া সব থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য ।



লেখিকা পরিচিতি

শালিনী ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।


Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page