অনির্বাণ দাস

‘আরম্ভিছে শীতকাল, পড়িছে নীহার-জাল, শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুলপত্রহীন;-
শীতের প্রারম্ভে প্রকৃতি যতই রিক্ত,শূন্য হোক, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'প্রাকৃতজগত সকল কালের সকল স্থানের সকল তথ্য নিয়ে, সাহিত্যজগৎ সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষের কল্পনাপ্রবণ মন নিয়ে। তাই প্রতি ঋতুর শিক্ষা প্রতি ঋতুতে নিতে হবে।' তাই বর্ষা কবির প্রিয় ঋতু হলেও শীতের প্রভাব থেকে রবীন্দ্র সাহিত্য মুক্ত নয়।জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় তা ভাস্বর হয়ে উঠেছে।রবিকণা ছড়িয়ে পরেছে শীতের আঙিনায়।
ছোটবেলায় দুলে দুলে পড়া রবি ঠাকুরের ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে॥’ –কবিতাটি শীতের বর্ণনা বলতে গেলেই সব থেকে আগে মনে পড়ে।কবির বর্ণনায় অঘ্রান সারা হলে উত্তুরে হিমেল বাতাসের হাত ধরে শীত তার কুহেলিকা জাল বিছিয়ে দেয় বঙ্গ প্রকৃতির আনাচে কানাচে।‘বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস/স্বচ্ছসলিলা বরুণা’ সামান্য ক্ষতি
প্রকৃতিতে শীত বরণের যে আয়োজন চলে তা কবির লেখনীতে আবেগঘন ভাষায় ব্যক্ত।সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হলেই তো শীতের শুরু।শিথিল কুন্দের ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি শীতের জীর্ণতার খোলসমুক্ত করে গেয়ে ওঠেন নতুনের জয়গান-
‘মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে পার হয়ে এল চলি;
তার পানে, হায়, শেষ চাওয়া চায় করুণ কুন্দকলি।
উত্তরবায় একতারা তার
তীব্র নিখাদে দিল ঝংকার,
শিথিল যা ছিল তারে ঝরাইল, গেল তারে দলি দলি’ বোধন
স্থবির বৈরাগ্যের অনুভূতি নিয়ে উত্তরের বাতাসে ভর করে শীত আসে কুয়াশার পাখনায় নিশির শিশির নিয়ে, আমলকির ডালে কাঁপন ধরিয়ে।
‘উত্তর-বায়ু-ভরে
বক্ষে কাঁপন ধরে,
রোদ্দুর লাগে তাই মিঠে।‘শীত
সত্যি তো শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় মিঠে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ে বন থেকে বনান্তরে-
‘সোনা-মেশা সবুজের ঢেউ
স্তম্ভিত হয়ে আছে সেগুন বনে।
...
কাজ ভোলা এই দিন
উধাও বলাকার মতো
লীন হয়ে চলেছে নিঃসীম সীমানায়।’ শীতের রোদ্দুর এই সুখের পরশ কিন্তু মানুষকেও ছুঁয়ে যায়-
‘তারি 'পরে মোক্ষদা বুড়ি
মাথা ঢুলে পড়ে বুকে
রৌদ্র পোহায় সুখে
জীর্ণ কাঁথাটা দিয়ে মুড়ি।‘ শীত
কনকনে ঠাণ্ডায় গরম পোশাক আর কাঁথা বা লেপ মুড়ি দিয়ে শীতের ওম নিতে গিয়ে আবার বিপদের মজা কবির চোখ এড়ায় নি।
‘কন্কনে শীত তাই চাই তার দস্তানা; বাজার ঘুরিয়ে দেখে, জিনিসটা সস্তা না। কম দামে কিনে মোজা বাড়ি ফিরে গেল সোজা— কিছুতে ঢোকে না হাতে, তাই শেষে পস্তানা।‘ খাপছাড়া
দিন শেষে যখন রাখাল গাভী নিয়ে গোয়ালে ফিরে আসলেই ছোট দিনের বেলা শেষ হয়ে যায়। কবির কাছে শীত মানে দিনের শ্রান্তি। কবির ভাবনায়-
‘শ্রান্ত হয়েছে দিন,
আলো হয়ে এল ক্ষীণ,
কালো ছায়া পড়ে দিঘি-জলে।
শীত-হাওয়া জেগে ওঠে,
ধেনু ফিরে যায় গোঠে,
বকগুলো কোথা উড়ে চলে।
আখের খেতের আড়ে
পদ্মপুকুর-পাড়ে
সূর্য নামিয়া গেল ক্রমে।
হিমে-ঘোলা বাতাসেতে
কালো আবরণ পেতে
খড়-জ্বালা ধোঁওয়া ওঠে জ'মে।‘ শীত
সত্যিই তো শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এলে মনের কথা এলোমেলো ভাবে শুকনো পাতার স্রোতে এমনভাবে ছড়িয়ে আর কে পারেন! শিরীষের পাতাগুলো ঝরে পড়লে কবি তার মনে এক ধরনের আকুলতা খুঁজে পান।শীত কবিমনকে নিয়ে অনুক্ষণ খেলা করে।
‘এই যে শীতের আলো শিহরিছে বনে,
শিরীষের পাতাগুলি ঝরিছে পবনে—
তোমার আমার মন
খেলিতেছে সারাক্ষণ
এই ছায়া-অলোকের আকুল কম্পনে,
এই শীত-মধ্যাহ্নের মর্মরিত বনে।‘ স্মরণ-২৭
মাঘের সূর্য উত্তরায়ণ পার হলেই ‘এল যে শীতের বেলা’ আর শীত মানেই ‘রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে’ আর ‘ডালা যে তোর ভরেছে/ আজ পাকা ফসলে।' আর বাঙালীর গোলা ভরে ওঠে সোনালী ধানে।
তবে শীত চলে গেলে ফাগুন আসবে আমাদের ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিতে। ফুলে ফুলে সাজানো চরণতলে প্রিয়া আঁচল বিছিয়ে একলা রয়েছে-এ যে যাবার মুখে ফিরে আসার গান-
‘শীর্ণ শীতের লতা আমার মনের কথা হিমের রাতে লুকিয়ে রাখে নগ্ন শাখার ফাঁকে ফাঁকে, ফাল্গুনেতে ফিরিয়ে দেবে ফুলে তোমার চরণমূলে যেথায় তুমি, প্রিয়ে, একলা বসে আপন মনে আঁচল মাথায় দিয়ে।’ পূরবী-শীত কবি কিন্তু আশাবাদী- রিক্ত হলেই প্রকৃতি আবার ফুলে ফলে পূর্ণ হবে, হেসে উঠবে।আসা যাওয়ার পথের ধারে পড়ে থাকবে বসন্তের আগমনী বার্তা। ‘শীত চলে যায়, ফিরে ফিরে চায়, মনে মনে ভাবে এ কেমন বিদায়। হাসির জ্বালায় কাঁদিয়ে পালায়, ফুল-ঘায় হার মানে। শুকনো পাতা তার সঙ্গে উড়ে যায়, উত্তরে বাতাস করে হায় হায়, আপাদমস্তক ঢেকে কুয়াশায় শীত গেল কোন্খানে।‘ শিশু-শীতের বিদায়
শুকনো পাতা উড়িয়ে দিয়ে শীত বিদায় নেবে ঠিকই, কিন্তু জানিয়ে দিয়ে যাবে আগামীর সম্ভাবনা- কুহেলিকা উদ্ঘাটন করে প্রকাশ হবে ঋতুরাজ বসন্তের- ‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরই জয়,--
যুগের পরে যুগান্তরে মরণ করে লয়।
তাণ্ডবের ঘূর্ণিঝড়ে
শীর্ণ যাহা ঝরিয়া পড়ে,
প্রাণের জয়-তোরণ গড়ে
আনন্দের তানে,
বসন্তের যাত্রা চলে অনন্তের পানে।’ নটরাজ
প্রকৃতি প্রেমিক কবির কবিতায় ঋতুর রূপ বর্ণনা তো থাকবেই, কিন্তু দার্শনিক রোমান্টিক কবির ভাবনায় দার্শনিক উপলব্ধি আসবে না, এ তো হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় শীতের বাহ্যিক রূপ প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-
‘বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
স্বচ্ছসলিলা বরুণা।’
যেখানে মাঘের প্রবল শীতে বাঘও কাবু হয়ে যায় সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।কিন্তু রাজমহিষী শীত নিবারণের জন্য দরিদ্র মানুষের সামান্য কুঁড়েঘরে আগুন জ্বালাতে কুণ্ঠিত হন না।
‘ "ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়
কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল'--
এত বলি রানী রঙ্গে বিভল
হাসিয়া উঠিল মধুরে।
কহিল মালতী সকরুণ অতি,
"একি পরিহাস রানীমা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটির কোন্ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্ দীনজন কোন্ পরবাসী
বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!'
রানী কহে রোষে, "দূর করি দাও
এই দীনদয়াময়ীরে।'
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
আগুন লাগালো কুটিরে।’
এ তো কেবল রাজমহিষীর স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ নয়, এ যে ধনাঢ্য মানুষের নিম্নবর্গের মানুষকে শোষণ ও নির্যাতনের অমানবিক প্রকাশ, বিত্তের অহংকারে মদমত্ত মানবের নীচতা প্রদর্শন।
‘রুষিয়া কহিল রাজার মহিষী,
"গৃহ কহ তারে কী বোধে!
গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটির,
কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর?
কত ধন যায় রাজমহিষীর
এক প্রহরের প্রমোদে!'
এখানেই তো রবিকবি অন্যদের থেকে পৃথক- শীতের বাহ্যিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে দেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধির অনুভূতিকে।
মানবতাহীনতায় ব্যথিত কবি যেমন কেঁদে উঠেছেন, তেমনই শীতের স্পর্শে, উত্তুরে হাওয়ার ছোঁয়ায় কবিমনে লেগেছে প্রেমের শিহরণ-খুলে গিয়েছে প্রেমের অবারিত উৎস। শীতের আবহ কবিকে করেছে উন্মনা ও আকুল-
‘ডেকেছো আজি, এসেছি সাজি, হে মোর লীলাগুরু- শীতের রাতে তোমার সাথে কী খেলা হবে শুরু! ভাবিয়াছিনু গতিবিহীন গোধূলিছায়ে হল বিলীন পরাণ মম, হিমে মলিন আড়ালে তারে হেরি? উত্তরবায় কারে জাগায়, কে বুঝে তার বাণী- অন্ধকারে কুঞ্জদ্বারে বেড়ায় কর খানি।‘ উদ্বোধন
শীতের প্রাক্কালে মানুষের হৃদয়ে যে অনুভবের পরিবর্তন ঘটে, তার রূপ উন্মোচন করেছেন কবি। তাঁর কবিমানস শীতকে জীবনের আনন্দময় অধ্যায়ের পূর্বরাগ হিসেবে কল্পনা করেছে।কবি শিশিরসিক্ত ঘাসে পা ডুবিয়ে শীতের সকাল মেখেছেন চিরকালীন বাঙালিয়ান মননে।আর কবি মানসের অনুসারী হয়ে কলসী ভরা এখো গুড়ের মন মাতানো গন্ধে মাতাল হয়ে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে একটি ধানের শিসের উপর একটি শিশির বিন্দু দেখতে দেখতে আমরাও কি শীতের রূপের অধরা মাধুরী খোঁজার ইচ্ছায় বলে উঠবো না “শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা।”

লেখক পরিচিতি
অনির্বাণ দাস, রবীন্দ্রমেলার সদস্য
Comments