top of page

কুখ্যাত 'দি ক্রলিং অর্ডার' ও কবির ক্রোধ

মৃণালকান্তি চক্রবর্তী



       ১৯১৯ সালে ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার খবর টুকরো টুকরো ভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে কখন কীভাবে এসেছিল সেটি নানা জনের লেখায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং এর অনেকটাই অনুমান। কিন্তু এই বর্বরতার খবর অনেকটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে বিশ্বাস করার মতো। যার জন্য তাঁর অস্থিরতা, ক্ষোভ, চিত্তচাঞ্চল্য ও ক্রোধ তাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে ২৭শে মে কলকাতায় আসতে বাধ্য করল কিছু একটা করার জন্য। কলকাতায় জাতীয় নেতা চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হলেন। তখন সিদ্ধান্ত নিলেন ‘নাইটহুড’ সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার। ১৯১৫ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশরা রাজভক্তজাত। তাই রাজার দেওয়া সম্মান প্রত্যাখ্যান করলে-সমগ্র ব্রিটিশ জাতির আত্মাভিমানে আঘাত করা যাবে। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো–তিনি একজন নেতাকে (সম্ভবত ব্যোমকেশ চক্রবর্তীকে) প্রস্তাব করলেন যে, আসুন-আমরাও অমৃতসরের ঐ হতভাগ্য মানুষগুলোর মতই কলকাতার কোন একটা পথ বুকে হেঁটে চলাচল করে প্রতিবাদ করব। এই বুকে হেঁটে অমৃতসরের বিশেষ একটা রাস্তা পার হওয়ার নির্দেশই হচ্ছে-General Reginald Dyer এর কুখ্যাত Crawling Order. বিষয়টি সরাসরি আলোচনার আগে একটু পিছনে তাকাই। প্রসঙ্গক্রমে সভ্য শাসকের পাশবিকতা যে কতটা কুৎসিত বিকৃত রুচি ও ভারতীয় বিদ্বেষী হতে পারে তারও দু’একটা উল্লেখ করব।

       প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমদিকে ১৯১৫ সালে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমন করার জন্য এবং ভারত উপনিবেশকে যুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষে অংশগ্রহণে বাধ্য করানোর জন্য চালু হয় কুখ্যাত ভারতরক্ষা আইন। ১৯১৮ সালে এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে সভ্য ব্রিটিশ জাতির অসভ্য দম্ভ ও বর্বর দমননীতি ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে আরও হিংস্রভাবে ধ্বংস করার জন্য তৈরী করল রাওলাট এ্যাক্ট ১৯১৯ সাল। এই এ্যাক্টের বিরুদ্ধে দিল্লী, লাহোর, অমৃতসরে প্রতিবাদ আন্দোলন ফেটে পড়ে। গান্ধিজী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে তখন ভারতের রাজনীতিতে সদ্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর আদর্শনিষ্ঠা ও সত্যনিষ্ঠায় অভিভূত রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘মহাত্মা’ অভিধায় অভিহিত করেছেন। কুখ্যাত ‘জালিয়ানয়ালা বাগ’ হত্যাকাণ্ডের তিনদিন আগেই ‘রাওলাট এ্যাক্ট’ বিরোধী আন্দোলন অমৃতসরে তীব্র আকার ধারণ করে। ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে বেশ কিছু হতাহত হয়। ১০ই এপ্রিল জওহরলালের বিশেষ বন্ধু এবং উচ্চশিক্ষিত কেম্ব্রিজে পড়া মুসলমান ব্যারিস্টার ডাঃ কিচলু এবং উচ্চশিক্ষিত মিলিটারীতে কাজ করা ডাক্তার ও হিন্দু আর্য সমাজী অহিংসবাদী কংগ্রেস নেতা ডাক্তার সত্যপাল-এর গ্রেপ্তার এবং দিল্লী থেকে অমৃতসরগামী গান্ধিজীকে স্টেশনে নামতে না দিয়েই সেই ট্রেনেই বোম্বাই পাঠিয়ে দেওয়ার সংবাদ পেয়ে আরও উত্তেজিত ও ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা উত্তেজনায় ফেটে পড়ে এবং সাধারণ ইউরোপীয় নাগরিকদের উপরও আক্রমণ করতে শুরু করে। এই সময় অন্যদের মধ্যে মহিলা চিকিৎসক Mrs. Easdon এবং একটি মেয়েদের স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট Miss Marcella Sherwood ও আক্রান্ত হন। Miss Sherwood বেশী নিগৃহীত হন একটি রাস্তার উপরে। রাস্তাটি একটি সরু গলি। নাম কুচা কুরিচ্চান (Kucha Kurichhan)।

     এসবই এপ্রিলের ১০ তারিখের ঘটনা। জেনারেল ডায়ারের নৃশংস দমননীতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তিনি সুযোগ পেয়ে যান দুই দিন পরেই জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরস্ত্র জনতার উপর পরিকল্পিতভাবে গুলি চালানোর। পালানোর পথ নেই। চারিদিক পাঁচিল ও প্রতিবেশীদের বাড়ি দিয়ে ঘেরা। বাগের পাঁচটি প্রবেশ পথের চারটিই বন্ধ। একটিই খোলা। সেখানেই ডায়ারের সশস্ত্র মিলিটারীর মেশিনগান ও বন্দুকের গাড়ি- যা থেকে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ হচ্ছে।

             দিনটি বৈশাখের প্রথম দিন। শিখদের নববর্ষ। ফসল ঘরে তোলার পর কৃষকদের আনন্দ উৎসব। এই দিনেই ১৬৯৯ সালে শিখগুরু গুরু গোবিন্দ সিংহ তার প্রথম খালসা উদযাপন শুরু করেন।অমৃতসরে এই দিনটি শিখ-হিন্দু-মুসলমান সকল সম্প্রদায়েরই পবিত্র দিন। সেখানেই রাওলাট এ্যাক্টের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য একটি সভাও আহুত হয়েছিল। কানাইহালাল ভাটিয়া নামে একজন আইনজীবী এই সভার আহ্বায়ক ছিলেন। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের এক জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছে বিশাল জনতার সাথে। নেতা ও সমর্থক শ্রোতাদের একটি ঘেরা পাঁচিলের মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। একটি বিরাট সুযোগ ডায়ারের হাতে এসে গেল। General Dyer-এর স্ত্রী Annie Dyer তাঁর ডায়েরীর পাতায় লিখছেন –“How was he (Dyer) to fight the rebels, to bring them to decisive action in the narrow streets & winding lanes of Amritsar?... unless, indeed, he could get them somehow in the open. But this unexpected gift of fortune ... this concentration of the rebels in a open space-it gave him such an opportunity as he could not have devised.”

         লক্ষ্যণীয়, উদ্ধৃতির মধ্যে unexpected gift of fortune... শব্দবন্ধটি। সভ্য ইংরেজের কি কুৎসিত মানব বিদ্বেষ।

         রামনবমী উপলক্ষ্যে ৯ই এপ্রিল ছেলেদের একটি সুসজ্জিত শোভাযাত্রা সংগঠিত করেছিলেন মৌলভি গোলাম জিলানি। তিনি ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। তাঁকে তিনবার গ্রেপ্তার করে ডাক্তার কিচলু ও ডাক্তার সত্যপালের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চাপ দেওয়া হয়। তৃতীয়বার গ্রেফতার করার পর তাঁর উপর যে অত্যাচার করা হয় তাঁর বিবরণ তাঁরই জবানে-‘ … They began to beat me without saying anything. They beat me till I passed urine. Then they caused my trousers to be put off, and beat me severely with shoes and a crane … They beat me until I became senseless … not content with that he one (Keshor Singh) pushed a stick into my anus … I could not bear the agony and became unconscious.”

অমৃতসরের Bar Council-এর আইনজীবীরাও রাওলাট এ্যাক্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সক্রিয় হয়েছিলেন। ডায়ারের নির্দেশে সেই আইঞ্জীবীদের ধরে Constable এর কাজ করানো হত। এইরকম একজন প্রবীন আইনজীবী কানাইহালাল ভাটিয়া। পঁচাত্তর বছর বয়স। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদী আন্দোলন সভার তিনি ছিলেন আহ্বায়ক। তাঁর বিবৃতিতে- “ In my old age I was made to work like a coolie, carrying tables and chairs from one place to another & had to patrol the city in the hot sun. The abuse which was showered on us & the indignities to which we were put, added greatly to our sufferings … the local Bar takes part in public affairs & it took a prominent part in the Rowlat Act agitation. That is why the whole Bar was punished in this way.”

         উত্তেজিত জনতার হাতে Miss Sherwood যেখানে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন সেই গলির নাম কাচা কারিচ্চান। দেড়শো গজ লম্বা। গলির দুদিকে দুটি ব্রিটিশ মিলিটারী পুলিশের পিকেট বসানো হয়েছিল। সকাল ছটা থেকে রাত্রি ৮ টা পর্যন্ত কারফিউ জারি। ডায়ারের নির্দেশ ছিল ...to crawl the 150 yards of its length “on all fours” অর্থাৎ হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া যাকে বলে। কিন্তু ব্রিটিশ সেনারা ভারতীয়দের এই হেনস্থা দেখে মজা পাওয়ার জন্য হামাগুড়ির বদলে সেটাকে করল বুক, পেট ও হাত দিয়ে সরীসৃপভঙ্গী (crawling exactly like reptiles).

          এই শাস্তি প্রথম যে এগারো জনকে দেওয়া হয়েছিল তাঁরা হলেন যাঁরা ডায়ারকে পথে দেখেও সালাম করেননি। কাহান চান্দ নামে এক অন্ধ ভিখারীর বিবৃতি ... I have been blind for the last twenty years. About 18th April, while I was going my way into the street with the support of a stick that I always carry, I was asked by a police man to halt… I informed the policeman that I had been practically starving for the last two days… I then had to crawl on my belly, and had hardly gone a few yards when I received a kick on by back, and my stick slipped off hands.”

         Crawling order বলবৎ যে পথে, সেইখানে অভিযুক্তদের কাউকে কাউকে ধরে এনে প্রত্যেককে তিরিশ ঘা করে চাবুক মারা হত। এই রকম অত্যাচারের একটি বর্ণনা –পণ্ডিত শালিগরাম, একজন মিউনিসিপ্যালিটি কর্মচারী। যিনি কাচা কারিচ্চান রাস্তার পাশেই স্বচক্ষে দেখেছিলেন ছয়জনকে সেইদিন পরপর চাবুক মারা হয়েছিল।… I witnessed the flogging of six boys in front of Kucha Kurrichhan. Sunder Sing was the first to be fastened to the flogging post & given thirty stripes. He became senseless after the fourth stripes … some water was poured into his mouth … he regained consciousness, he was again subjected to flogging. He lost consciousness for the second time, but flogging never ceased till he was given thirty.” এরপর আরও পাঁচজনকে। এই দুঃসহ দৃশ্য দেখতে দেখতে শালিগরাম নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখলেন-When I recovered my consciousness, I saw the six boys who had just received the flogging, were bleeding badly. They were all handcuffed, and as they could not walked even a few paces, they were dragged away by the police. They were then taken to the Fort.”

         চাবুক মারার এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯০৭ সালে বিপিনচন্দ্র পালের বিচারের সময় তখনকার প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের আদালতে (বর্তমানে লালবাজার পুলিশ হেড অফিস) ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দেওয়ার জন্য ১৪ বছরের কিশোর সুশীল সেনের উপর ১৫ ঘা বেত মারার দৃশ্য। ঠিক একইভাবে একই পদ্ধতিতে। প্রত্যক্ষদর্শী উপস্থিত বিপ্লবী নেতৃত্ব সেই সন্ধ্যায় অরবিন্দ ঘোষের সভাপতিত্বে মানিকতলা আখড়ায় কিংসফোর্ডকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। যার পরিণতি মজঃফরপুরে কিংসফোর্ড-এর উদ্দেশ্যে বোমা ছোঁড়া থেকে ক্ষুদিরামের ফাঁসি।

       তখনও ১৯০৫-এ স্বদেশী আন্দোলনের সময় ইংরেজরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়ে তার সুযোগ নিতে চেয়েছিল। এখনও অমৃতসরে হিন্দু-মুসলমান বনাম শিখ সম্প্রদায়ের বিভেদ ঘটিয়ে ডায়ার এবং ও ডায়ার ১ তার সুযোগ নিয়েছে। ডায়ারের প্রতি শিখদের ধর্মীয় নেতৃত্বের তোষণ মনোভাব এতটাই ছিল যে ঐ বছরই এপ্রিলের শেষের দিকে স্বর্ণমন্দিরে একটি অনুষ্ঠানে ডায়ারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে সাম্মানিক সদস্যপদ দিতে চেয়েছিলেন, যা অতীতে কোনোদিন হয়নি। ডায়ার পত্নী Annie পরবর্তীকালে ঘটনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন – “ Sahib” they said, “you must become a Sikh”. The General thanked them for the honour, but objected that he could not, as a British officer let his hair grow long …”we will let you off the long hair” said one of them.”But I cannot give up smoking”-Dyer said.” That you must do” said Arur Singh.”No” said the General,”I am vert sorry, but I cannot give up smoking.” The priest conceded “we will let you give it up gradually.”” That I promise you” said the General ”at the rate of one cigarette a year.”

       ক্ষমতাদম্ভী সভ্যের বর্বরতার কয়েকটি মাত্র উল্লিখিত হল-ভবিষ্যৎ অধ্যয়ন হয়ত আরও ঘটনা উদঘাটিত করবে। কিন্তু যেটুকু সংবাদ কবির কাছে পৌঁছেছিল তাতে কবির একক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই-তাঁর নিজসব গভীর মানবতাবোধ, যা রাজনীতিবিদদের চর্চিত মানবতাবাদ থেকে স্বতন্ত্র। কবির অনুভূতিতে যে বেদনা তা রাজনীতির কৌশল ও ছল-চাতুরীর অপেক্ষা করে না। অমৃতসরের মানুষদের উপর শাসকের অত্যাচার মনুষ্যত্বের অপমান। যা তখন কেবলমাত্র কবিকেই ব্যথিত, উত্তেজিত ও প্রতিবাদী করে তুলেছিল। তাই ক্রুদ্ধ কবির অগ্নিবর্ষী ভাষায় লেখা নাইটহুড সম্মান প্রত্যাখানের ভাষা একটু নম্র করার অনুরোধ করলে এ্যন্ড্রুজ সাহেবের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন তা সাহেবের ভাষায়-“কবির এমন ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আমি অতীতে বা পরবর্তীকালে কোনোদিন দেখিনি।”


   *** 




বিঃদ্রঃ- ১)পাঞ্জাবে তখন দুজন ডায়ার ছিলেন-একজন মাইকেল ও. ডায়ার (ছোটলাট)। আর একজন জেনারেল রেজিনেল্ড ডায়ার। প্রথমজন O.Dwyer ও দ্বিতীয়জন Dyer বলে পরিচিত।

২)পরবর্তীকালে হান্টার কমিশন ও জাতীয় কংগ্রেস নিয়োজিত কমিশনের সদস্যদের কাছে অমৃতসরের মানুষদের দেওয়া বিবৃতির ইংরেজী অনুবাদ।

৩) অত্যাচারের তথ্যগুলি Nigel Collett –এর লেখা ‘The Butcher of Amritsar’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।









লেখক পরিচিতি

শ্রী মৃণালকান্তি চক্রবর্তী, রবীন্দ্রমেলার সভাপতি ও বহরমপুর কলেজর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page