অতসী সরকার

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিচিত্রগামী তাই, ছোটদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঔৎসুক্য স্বাভাবিক।রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পাঠকালে বিস্মিত হতে হয়। তাঁর কবিতা, গান-চিঠি-ভ্রমণবৃত্তান্ত আমাদের মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ শুধু ছোটদের জন্য ছড়া, কবিতা ও গান লেখেননি, ছোটদের অক্ষর পরিচয়ের জন্য এবং ওদের আকৃষ্ট করার জন্য নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি যুক্ত করে ১৯৩০ সালে ‘সহজপাঠ’ প্রকাশ করেছিলেন, যা অচিরেই হয়ে ওঠে ছোটদের পড়া পড়া খেলা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবকালের কথা লিখে গেছেন ‘শিশু’ ও ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থে। এই দুটি গ্রন্থ আমাদের শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। ১৩১০ বঙ্গাব্দে এই ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বারে বারে শিশুদের মনোজগতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন । রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যের মূল চরিত্র হল খোকা ও তার মা-র কথা। যত প্রশ্ন, যত গল্প, যত আবদার, যত অভিমান, যত ইচ্ছা সব তার মায়ের সঙ্গে। মা-ই তার একমাত্র বন্ধু এবং সমব্যথী।এই দুটি চরিত্রের মধ্যে শিশু রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর মায়ের ছায়া যেন ভেসে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের শিশুসুলভ সত্ত্বাকে এই দুই কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতার ছন্দে ছন্দে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“খোকা মাকে শুধায় ডেকে-
‘এলেম আমি কোথা থেকে,
কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?’
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে-
ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।। (শিশুঃ জন্মকথা)
শিশু কাব্যগ্রন্থে কবি পৃথিবীর সমস্ত শিশুর মনের কথা তুলে ধরেছেন। খোকার ‘বিচিত্র সাধ’-কখনো ফুলবাগানের মালী, কখনো রাখাল ছেলে, গাড়োয়ান, পাহারাওয়ালা- কখনো রাজমিস্ত্রী হওয়ার। সে কখনো পুঁথি পড়া পণ্ডিত হতে চায় না। কেউ তাকে জামা পড়তে বলবে না, রাত্রি ১০-১১ টা বাজলে শুতে যেতে বলবে না। সে চায় খুব স্বাধীন জীবন। ‘মাঝি” কবিতায় খোকার ইচ্ছা, সে খেয়া ঘাটের মাঝি হয়ে এপার-ওপার দুই পারের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখবে।
আবার ‘লুকোচুরি’ কবিতায় খোকা দুষ্টামি করে ভোরের চাঁপা হয়ে ফুটলেও মায়ের সকল ইচ্ছার সঙ্গে সে জড়িয়ে থাকতে চায়। দুপুরবেলা মা যখন মহাভারত হাতে জানালার কাছে এসে বসবে, তখন চাঁপা ফুল হয়ে যাওয়া খোকার ছোট্ট ছায়া সে মায়ের বই-এর ’পরে দোলাবে। কিন্তু মা কিছুতেই ধরতে পারবে না, ছোট্ট ছায়াটি তার খোকার।সারাদিন মায়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেললেও সন্ধ্যেবেলা সে কিন্তু মায়ের কোলে ফিরে আসবে।
আবার ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের ‘দুষ্টু’ কবিতায় খোকার অভিমান প্রকাশ পেয়েছে। মা যখন খোকাকে অন্যদের থেকে বেশি দুষ্টু দুষ্টু বলে বকাবকি করেন ও বলেন মিত্তির বাড়ির কালু, নীলু, সতীশ, ন্যাড়া-এরা খোকার চাইতে ভাল তখন খোকার মন দুঃখে ভরে যায়। ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের ‘দুয়োরাণী’ কবিতায় আবার শিশুর অন্য চিন্তা। মাকে নিয়ে নিজের তৈরি কুঁড়ে ঘরে সে থাকতে চায়। বাঘ, ভাল্লুক, রাক্ষস-খোক্কস কাউকেই সে মায়ের কাছে ঘেঁসতে দেবে না।
“ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে;
শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে
থাকব দুজনেই।”
রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে আমরা মাকে শিশুর সবচেয়ে আপনজন এবং সুখ-দুঃখের সাথী হিসাবে দেখতে পাই। শিশুর যে কোন সমস্যায় মা-ই একমাত্র সমাধানের জায়গা ও ভরসাস্থল।
রবীন্দ্রনাথ ‘গীতিচর্চা’য় ছোটদের জন্য অনেক গান রচনা করেন, যেমন-
১) আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
২) আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়
৩) মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত গান ও কবিতার মাধ্যমে শিশুদের মনের বিচিত্র আশা আখাঙ্খা তুলে ধরেছেন। এই স্বল্প পরিসরে সমস্ত উদাহরণ টানা সম্ভব নয়। ছোট্ট বন্ধুরা যারা ‘ছোটদের রবীন্দ্রনাথ’কে জানতে চাও, তারা ‘শিশু’ ও ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থ দুটি পড়তে পারো।

লেখিকা পরিচিতি
অতসী সরকার, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।
Comments