অমিতা ঠাকুর

যার প্রতিভার পরিমাপ করা যায় না, তার বিষয়ে কিছু বলতে গেলে কি যে বলব ভেবে পাইনে। সকলেই তার কথা শোনবার জন্য আগ্রহী। ছোট ছোট ঘটনা - টুকরো টুকরো কথার মধ্য দিয়ে তার একটা চারিত্রিক ছবি পাওয়া যায় তাই আজ তার ভৃত্যবৎসলতার কথা একটু বলবো।
ঠাকুর পরিবারে সকলেই অল্পাধিক ভৃত্যবৎসল। মহর্ষিদের ষোলোজন সেবক ছিল। তারাও বেশ আদর পেত। কে একজন ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন মহর্ষির এই ভৃত্যপ্রীতি দেখে যে, “এতগুলি পুত্র নিয়েও সাধ মেটেনি আরও পালিত পুত্রের প্রয়োজন!” মহর্ষির পুত্র পৌত্রাদিক্রমে এই ভৃত্যপ্রীতি দেখেছি।
রবীন্দ্রনাথের উমাচরণ নামের সেবকটিকে দেখিনি কিন্তু তার কথা অনেক শুনেছি। প্রভুভক্ত উমাচরণ একাধারে ওঁর যখন যা প্রয়োজন সবই করত। উমাচরণকে নইলে তাঁর চলত না। শেষকালে ওর বুকের দোষ হয় খুব সম্ভব ক্ষয়রোগ। ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ ওর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেন ও তার যা প্রয়োজন সব দেন। কম দুঃখ পাননি ওর এই অসুখের জন্যে।
এরপর দেখেছি সাধুচরণ নামে এক বাবু চাকরকে। তার ধুতি পাঞ্জাবী এতো ধবধবে সাদা ও ইস্ত্রি করা যে তাকেই বাবু বলে মনে হত। তখন রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনেই বেশি থাকতেন। -তাই যতদূর জানি বেশিদিন সে ছিল না। শেষ অবধি ছিল যে তার নাম বনমালি, সে। উড়িষ্যা দেশের লোক। গ্রাম্য সরলতাটি তার ছিল স্বাভাবিক অকপট ভালবাসা। তাই তাকে খুব ভালোবাসতেন।
যার সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করা যাবে না এমন লোক যতই কাজেরই হোক না কেন ওঁর পোষাত না। বনমালিকে কখনও কখনও আদর করে ডাকতেন ‘লীলমণি’ (নীলমণি)। রাত্রেও বনমালী সজাগ থাকত কখন তার বাবামশায় উঠে বাথরুমে যাবেন তার আগে মশা তাড়াবার জন্য flit spray করে আসবে – জানত যে মশার কামড় তাকে অস্থির করে তোলে। মশা তাড়াবার জন্য কতরকম কিছুই না করতেন। প্রতিদিনই একে নিয়ে নানারকম মজা করতেন, ও বুঝত না বলেই মজাটা জমে উঠত। বেশিরভাগ চা খাবার সময় বিকেলের দিকেই এসব হত।
একদিন বললেন, “হ্যাঁরে বনমালি, তুই বোধহয় আমার মধু টধু খাস -না?” বনমালিকে একথা বলামাত্র সে কানে হাত দিয়ে জিভ কেটে প্রায় কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, “কক্ষনো না বাবামশায়, আপনি যেটা খাচ্ছেন তাকি আমি খেতে পারি? তবে হ্যাঁ, আপনি যখন যেটা খাবো না বলে সরিয়ে দেন সেটা আমি খেয়ে দেখি। একবার যখন নিমের মধু আপনি খানিকটা খেয়ে আর খেলেন না – তখন ভাবলুম নিমের মধু আবার কি জিনিষ - দেখি তো খেয়ে তিতো নাকি। তাই দেখেছিলুম খেয়ে, আর মিথ্যে বলবনা ২/১ টা লজনচুস খেয়ে দেখেছি —আপনি সবাইকে দেন নিশ্চয় খুব ভালো জিনিষ হবে!”
খাবার সময় মুখের গোড়ায় বনমালী না থাকলে চলত না। একবার জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে নতুন গান লিখেছেন আমায় ডেকে পাঠালেন – তখন আড়াইটে তিনটে বেলা হবে। গানটি হচ্ছে “হে মাধবী ভীরু মাধবী তোমার দ্বিধা কেন/আসিবে কি ফিরিবে কি দ্বিধা কেন?” গানটা শিখছি ইতিমধ্যে ওঁর চা খাবার সময় হয়েছে - বনমালি ট্রে সাজিয়ে নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, দেখল যে গান শেখাচ্ছেন – তাই পাছে বিরক্ত হন এখন চা নিয়ে গেলে ভেবে আবার পর্দার আড়ালে চলে গেল। কিন্তু বোধ হয় মনে হল চা খাবার তো সময় হয়ে গেছে, দেরি হয়ে যাবে ভেবে আবার ঘরে ঢুকলো আবার আড়ালে চলে গেল পর্দার। বার দুই তিন এরকম হবার পর উনি দেখতে পেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে নেড়ে গাইতে লাগলেন, “হে মাধবী দ্বিধা কেন ? আসিবে কি ফিরিবে কি দ্বিধা কেন ?” ঘরে আরো কে কে ছিলে মনে নেই, আমরা সকলেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছি আর বনমালী ওঁর গানের কথার সঙ্গে সঙ্গে একবার আসছে আর একবার ফিরে যাচ্ছে। ও বোধ হয় ভাবছে বাবামশায় একবার নিয়ে আয়’ বললেই ও সাহস করে চা সামনে নিয়ে হাজির করে, কিন্তু উনি তো তখন ওকে নিয়ে রগড় করে গানই গাইছেন – একি ছাই ওসব বোঝে! এই থেকে কথায় কথায় পল্লবিত হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ওর উপরেই গানটি লেখা।
একবার অনেকদিন খবর না পেয়ে ওঁকে একটা চিঠি লিখেছিলুম শান্তিনিকেতনে, তার উত্তরে আমায় যে চিঠিটি লেখেন তাতে শেষকালে বনমালীর ঐ ঘটনা স্মরণ করে লিখেছিলেন একটু। চিঠি এখানে তুলে দিচ্ছি।। কল্যাণীয়াসু
অমিতা, সময় কই? কাল সমস্ত দিন ভিড় ছিল, আর সকাল বেলাতে এতক্ষণ নানা লোকে নানা আলাপ আলোচনা করে চলে গেলেন। রৌদ্র প্রখর হয়ে উঠল –হাওয়া তপ্ত হতে আরম্ভ করেছে। দূরে একটা কোকিল ক্লান্ত কণ্ঠে ডাকচে – দক্ষিণের বাতাসে বেল ফুলের গন্ধ, সামনে ঐ বিদ্যুদ্দীপের লৌহদণ্ডটার উপরকার লতায় অজস্র মাধুরী মঞ্জরী। স্নানের সময় হলো।।
শরীর আমার কেমন আছে জেনে তোর লাভ কি? ভালোই থাক আর মন্দই থাক দিন চলে যাচ্ছে। অনেক সময়ই কেদারায় হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি – মনের মধ্যে ভৈরবীতে গুঞ্জন করতে থাকে ঐ গানটা, “দিনের পর যায় দিন”–কখনো বা গেয়ে উঠি “আমি সুদূরের পিয়াসী” ।অপরাহ্নে ছাদে গিয়ে বসি। দর্শনার্থীরা আসে, অন্ধকার গভীরতর হয়ে এলে তারা চলে যায় – ইলেকট্রিক আলো নিবে যায় — তখন যে বিশ্বটুকু বাকি থাকে সে কেবল আকাশভরা তারা আর এই ছাদের উপরকার আমাকে নিয়ে। আর কি খবর আছে ভেবে পাচ্ছিনে। হ্যাঁ, বনমালী মাঝে মাঝে কমলালেবুর আর বেলের সরবৎ নিয়ে আসে, তখন খামোখা সেই মাধবীর গানটা মনে পড়ে। ইতি -২ বৈশাখ ১৩৩৮
দাদামশায়
বনমালী এই গানটি শেখার ঘটনায় বিখ্যাত হয়ে রইল। এই চিঠিটিতে এই সময়ের একটা ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে – সেই সঙ্গে বৈশাখের তপ্তক্রান্ত একটি মধ্যাহ্নের ছবি, কোকিলের ক্লান্ত কূজনও কেমন মিলে গেছে। আর পাওয়া যায় তার সেই সময়কার দিন যাপনের টুকরো একটু খবর। চিঠিটি ছোট হলেও বড় সুন্দর একটি চিত্র।
সেই বনমালী বুড়ো হয়েছে – তার হাত কাঁপে; খাবার দিতে গিয়ে যদি ফেলে টেলে দেয়। তাই ওঁর পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ও পুত্র রথীন্দ্রনাথ ওকে ডেকে বললেন, “বনমালি তুই বাড়ি যা —তোকে পেনসন দেব, মাসে মাসে বাড়িতে বসে টাকা পাবি।তোর এখন কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে, বাড়ি বসে বিশ্রাম কর।“
বনমালীর তো ভীষণ মন খারাপ -- বাবামশায়ের কাছ ছাড়া হ’য়ে সে থাকে কি করে? রবীন্দ্রনাথ তখন আছে ‘পুনশ্চ’ বাড়িটিতে। লিখেছেন – এমন সময় বনমালী তার কাছে দাঁড়ালো – বললো “বাবামশায় আমার তো ছুটি হয়ে গেল - দাদাবাবু বললেন আমায় বাড়ি যেতে, পেনসান দেবেন।”
বনমালীর মুখেই শোনা এ ঘটনা তাই তার জবানিতেই বলি –
“কি বলবো বৌমা, বাবামশায় তক্ষুনি কলম রেখে দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইলেন দেখে তো আমার ভীষণ ভয় হ’ল আর কষ্ট হ’তে লাগলো যে কেন বলতে গেলুম তাকে খানিকক্ষণ অমনি করে থাকার পর বললেন – না বনমালী, তোমার যাওয়া হবে না বৌমাকে বলবো।
বাব্বাং আমি তো বাঁচলুম – যা ভয় হয়েছিল বাবামশায়কে ওরকম দেখে যে কি বলি, তারপর বৌমাকে বললেন - বৌমা, বনমালী গেলে আমার চলবে না, ও থাকবে। তখন ঠিক হ’ল পেছন থেকে কেউ বনমালীর হাতে খাবার তুলে দেবে আর ও বাবামশায়ের মুখের সামনে ধরে দেবে সেটা।
তারপরের ঘটনা বড় করুণ। ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন! তার ক’দিন পর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমার মহলে ভাঁড়ার ঘরে কাজ করছি - বনমালী এসে দোর গোড়ায় ধপাস করে বসে পড়ল কাঁদে কাঁদো গলা বললো, “ বৌমা, বাবামশায় তো চলে গেলেন – কথা ছিল আমি আগে গিয়ে সব ঠিক ঠাক করে রাখব ওঁর কোনো কষ্ট না হয় – কিন্তু তা তো। আর হ’ল না, উনি আগেই যে চলে গেলেন না জানি ওঁর কত কষ্ট হচ্ছে! আমি ঠিক করেছি। দাদাবাবু আমায় যে টাকা দিয়েছেন তা দিয়ে আমি একটি সরোবর কাটবো নাম দেবো রবীন্দ্র সরোবর’, আর তারই ধারে একটি ঘর তুলে আমি থাকবো যতদিন না বাবামশায়ের কাছে যাই। ততদিন ওখানেই থাকবো –এই ভালো হবেনা বৌমা?” আমি ওকে বললাম, “খুব ভালো হবে। বাবামশায় খুব খুশি হবেন।” ও আমার কথায় খুশি হয়ে চলে গেল!
কত যে সরল ছিল বনমালী আর সবচেয়ে বড় কথা হৃদয়টি যে তার ভরা ছিল খাঁটি ভালোবাসায়, সেই ভালোবাসা দিয়ে পেয়েছিল তার বাবামশায়কে—যাঁর বনমালী ছাড়া একদণ্ড চলতো না।।
মানুষকে যিনি সবার উপরে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন – বারবার বলেছেন মানুষের উপরে বিশ্বাস হারিয়ো না, তিনি কি তাঁর এই গ্রামের খাঁটি মানুষটিকে ভালো না বেসে পারেন!

লেখিকা পরিচিত
অমিতা ঠাকুর : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র অজীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী। তাঁর বিবাহ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ গান লেখেন “এসো এসো আমার ঘরে এসো” | রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়জন ছিলেন, রবীন্দ্রভারতী থেকে তিনি ১৯৯১-এ ডি.লিট উপাধি পান।তার লেখা বই-‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির রান্না’, কাব্যগ্রন্থ - ‘জন্মদিন’ ও ‘অঞ্জলি।
Comments