সংযুক্তা দাস

রবীন্দ্রনাথ ও সুফি ভাবনা অথবা সুফিয়ানা, অভিন্ন। সুফিবাদের নির্যাস বলতে আমি বুঝি ‘প্রেম’। এমন কিছুর জন্য আকুলতা যা আমাদের থেকেও বৃহৎ, জাগতিকতার উর্দ্ধে। এই ‘প্রেম'-এর দীপ্তি লাভ করতে হলে সত্তার পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ যেমন দরকার, তেমনি পৃথিবীর ধূলিমাটি আর উত্তাপ ছাড়িয়ে পরমাত্মার সঙ্গে লীন হবার ব্যাকুলতাও থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তিনি মূলত কবি; হয়তো একজন মরমী; আর বিশ্বমানব তো বটেই। মানব অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাচেতনার প্রতিটি বাঁকে তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। তেমনি সুফিবাদ ও মানবাত্মার পরম আকাঙ্খার উৎসগুলো থেকেও তিনি উপজীব্য সংগ্রহ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হাফিজ, রুমি, সাদি অর্থাৎ সুফি কবিদের ভাবনার এক গভীর মিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই অবিকল প্রতিফলন রয়েছে। ছোট্ট একটি ফুল কল্পনা করে রবীন্দ্রনাথ পরমাত্মাকে আহ্বান করেছেন এইভাবে,“ছিন্ন করে লও হে মোরে, আর বিলম্ব নয়। ধূলায় পাছে ঝরে পড়ি এই জাগে মোর ভয়।” পাশাপাশি হাফিজের এই কবিতাটি উল্লেখ্যঃ
“মিলনের বারতা কোথা? আমায় উর্দ্ধে নেবে ডেকে-বরণ করতে তোমায়, ধূলোর ধরা ছেড়ে যাঁব উর্দ্ধলোকে!........
..... বাধা জগৎ্-সংসার আর নশ্বর এ জীবন; হে প্রভু! তোমার করুণা মেঘ হতে করো বর্ষণ।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে সংগীতের মূর্ছনায় তার কথামালা মূর্ত করে তুলছেনঃ “বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।” লক্ষণীয়, ধারণাগুলোর মধ্যে একটি মিল রয়েছে। তবে হ্যাঁ, মিলটি কেবল উৎসমূলে, তারপর সেখান থেকে বিকশিত হয়ে ভিন্ন দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। সুফিরা যেখানে ধুলোমলিন ধরা থেকে অনন্য উচ্চতায় আরোহণের জন্য ব্যাকুল, রবীন্দ্রনাথ সেখানে এ ধরাকেই জীবনের নাট্যমঞ্চ মনে করছেন এবং এখানেই সত্ত্বার মুক্তি সন্ধান করছেন। তিনি পৃথিবীকে অস্বীকার করছেন না, উপেক্ষাও করছেন না। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের দুটি অবস্থান, দুটি ভাবকে আমরা অনুধাবন করতে পারি এবং একটির সঙ্গে আরেকটিকে মেলাতে পারিঃ তিনি একাধারে কবি ও বিশ্বমানব, মরমী ও স্থপতি - একজন ঐশ্বরিকতার সন্ধান করেন, আরেকজন শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন, বিশ্বভারতী- যেগুলো তাঁর অগণিত জনহিতকর ও শিক্ষামূলক কাজের দৃষ্টান্ত।
রবীন্দ্রনাথ যে সুফিবাদ, স্বর্গীয় মিলনের প্রত্যাশায় এর ব্যাকুলতা, এর পরমানন্দময় ভাবাবেশ এবং সুফি কবিদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিলেন, এটা আমরা তাঁর নিজ মুখেই জানতে পারি। পারস্য-যাত্রী নামক ভ্রমণগ্রন্থে বিশিষ্ট একজন দর্শনার্থী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ “সকলে বলেন ইনি ফিলজফার; ....... ইনি আশা প্রকাশ করলেন আমার পারস্যে আসা সার্থক হবে। আমি বললুম, “আপনাদের পূর্বতন সুফীসাধক কবি ও রূপকার যারা আমি তাদেরই আপন, এসেছি আধুনিক কালের ভাষা নিয়ে; তাই আমাকে স্বীকার করা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবে না।’” তাঁর এ কথার সত্যতা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন। ইরানে সাদি ও হাফিজের সমাধিস্থলে তিনি রুদ্ধশ্বাসে বলেছেনঃ-“মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি।”
আত্মগন্ডির বাইরে আমরা এখন আর পা রাখি না। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে প্রেমকে দেখেছেন, যে প্রেমের জন্য সুফিগণ জীবনভর সাধনা করে গেছেন, অস্তিত্বের চূড়ান্ত শিখরে পৌছে আত্মচেতনা অর্জনের আকাঙ্থায় আমরা আর সেই প্রেমের দীপ্তিতে নিজেদের দ্যুতিময় করে তুলি না। মুহুর্তের তরে স্থিত হবার অবসর বুঝি নেই আমাদের।

লেখিকা পরিচিতি
লেখিকা রবীন্দ্রমেলা বহরমপুরের শুভানুধ্যায়ী
Comentários