তরুণ সাহিত্যসেবীদের বিশেষ অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ স্বকন্ঠে গাইলেন “অয়ি ভুবন মনোমোহিনী...।”
সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত
![](https://static.wixstatic.com/media/c9f588_818e92f668ba44a4ad812d466ade5ee5~mv2.jpg/v1/fill/w_693,h_430,al_c,q_80,enc_avif,quality_auto/c9f588_818e92f668ba44a4ad812d466ade5ee5~mv2.jpg)
কাশিমবাজারে প্রথম বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ ও মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্রের সঙ্গে বিভিন্ন সাহিত্যসেবীগণ
অনুষ্ঠান স্থল:কাশিমবাজার রাজবাটী প্রাঙ্গণ। তারিখ: ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ১৭ই কার্ত্তিক। রাজপ্রাসাদের সিংহদুয়ারে দাঁড়িয়ে কাশিমবাজারের দানবীর মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী স্বয়ং। রাজবাটীর তোরণদ্বারে তখন ধ্বনিত হচ্ছে নহবতের সুমধুর সুরলহরী। সময়: সকাল আটটা।কাশিমবাজার স্টেশন থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘোড়ার গাড়ীতে এক এক করে সসম্মানে নিয়ে আসছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, আচার্য্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, দুর্গাদাস লাহিড়ী, লালগোলাধিপতি রাও যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়, মন্মথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (ভাগলপুর), মহামহোপাধ্যায় প্রসন্নচন্দ্র বিদ্যারত্ন(ঢাকা), আহম্মদ হোসেন মিঞা, ঠাকুর প্রজাপতি সরকার(কাশ্মীর), নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত, মহম্মদ রৌশন আলি চৌধুরী সহ অবিভক্ত বাংলা, বিহার ও কাশ্মীরের সাহিত্য ও পণ্ডিত সমাজের চারশত জন সাহিত্য শিরোমণিকে। এদের মধ্যে প্রতিনিধিরূপে বহরমপুরের বৈকুণ্ঠনাথ সেন, নিখিলনাথ রায়, শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, নফরদাস রায়, মণিমোহন সেন, বোধিসত্ত্ব সেন প্রমুখ বিশিষ্টজনেরাও উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলন হয়েছিল ১৭ই ও ১৮ই কার্ত্তিক। ১৭ই কার্ত্তিক দুপুরে রাজবাটী প্রাঙ্গণে সুসজ্জিত মণ্ডপে উপস্থিত সকল প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সম্মুখে চিরঞ্জীব শর্ম্মার সুললিত উদাত্ত কন্ঠে গীত হলো উদ্বোধনী সঙ্গীত(মাঙ্গলিক গীত)।
“কবি মনোবিনোদিনী বাণী বরদে,
জ্যোৎস্না জাল বিকাশিনী শতদলবাসিনী সারদে...।”
ও
ও জ্ঞানদে, শুভদে সচ্চিদানন্দ রূপিনী
দেবী মহাবিদ্যে, পরমা আরাধ্যে আদ্যেশক্তি বাগ্বাদিনী...।”
অতঃপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, উদারহৃদয়, দেশহিতব্রতী, বঙ্গ সাহিত্যের আশ্রয়স্থল মাননীয় মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী আগত অতিথি ও প্রতিনিধি, সাহিত্যসেবীদের উদ্দেশ্যে স্বাগত ভাষণে বললেন-
“শুভাগত মহোদয়গণ,
আনন্দ পরিপূর্ণ চিত্তে ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হৃদয়ে আজি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিরূপে মুর্শিদাবাদবাসীগণের পক্ষ হইতে এবং আমার দীনগৃহে সাহিত্য সম্মিলনের অধিবেশন হইল বলিয়া নিজ পক্ষ হইতে আপনাদিগকে আন্তরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সহিত অভ্যর্থনা করিতেছি।মাতৃভাষার ও জাতীয় সেবা উপলক্ষ্যে বঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন স্থানের সুধীগনের এই শুভাগমনে মুর্শিদাবাদ ধন্য হইল, আমার গৃহ পবিত্র হইল, আমি কৃতার্থ হইলাম । মুর্শিদাবাদবাসী আমাদিগের যে আজি কি গৌরব ও আনন্দের দিন, তাহা বাক্যদ্বারা প্রকাশ করা আমার পক্ষে সুকঠিন...।”
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আহ্বানে ও উদ্যোগে প্রথম বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন যে সময় দুর্বার রূপ লাভ করেছে সেই সময় ১৩১২ বঙ্গাব্দের ৯ই ভাদ্র কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি সভায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের তৎকালীন সহসভাপতি মান্যবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে বাঙালীর ঐক্য সাধনের প্রয়োজনে বিশেষভাবে আহ্বান করে পরিষদকে জেলায় জেলায় পরিষদের শাখা স্থাপন করে পর্যায়ক্রমে জেলায় জেলায় পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন সম্পন্ন করার প্রস্তাব করেন। সেই অনুযায়ী বহরমপুরের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীকে সভাপতি করে সাহিত্য পরিষদের একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বছরে বছরে জেলায় জেলায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ঐ সম্মিলনে বাংলা সাহিত্যসেবীদের মিলন সাধন এবং বাংলার ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, দর্শন, ভূগোল, অর্থশাস্ত্র, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় মাতৃভাষায় আলোচনা ও অনুসন্ধান দ্বারা জাতীয় ঐক্য সাধনে ব্রতী হওয়ার সংকল্প করা হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩১২ বঙ্গাব্দের শেষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রঙপুর শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক সম্মিলন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জানান। আবার লাখুটিয়ার জমিদার শ্রীযুক্ত দেবকুমার রায়চৌধুরীও বরিশালে উক্ত সম্মিলন অনুষ্ঠিত করার জন্য সাহিত্য পরিষদকে আমন্ত্রণ করেন। অতঃপর বরিশালে ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ১লা ও ২রা বৈশাখ এই সম্মিলনের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ঐ সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নির্বাচিত করা হয়।
কিন্তু পূর্ববঙ্গে ও আসামে তৎকালীন প্রদেশ লেফটেন্যান্ট স্যার রামফিল্ড ফুলারের আদেশে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি নিষিদ্ধ হয় এবং ১লা ও ২রা বৈশাখ বরিশালে নির্ম্মম পুলিশী অত্যাচার হয় এবং শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা ও শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রেফতার হন।পুলিশ সাহিত্য সম্মিলন মণ্ডপ ও মঞ্চ বলপূর্বক ভেঙে দেয়।পুলিশ সভা নিষিদ্ধ করায় ২রা বৈশাখ সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সভ্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সভা স্থগিত করতে বাধ্য হন। ফলে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনের উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
অতঃপর কাশিমবাজারের সাহিত্যানুরাগী ও দানবীর মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর আহ্বানে কাশিমবাজারে ১৩১৩ বঙ্গাব্দের শেষভাগে উক্ত সাহিত্য সম্মিলনের স্থগিত সভা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সম্মিলন সভা আবার বাধার সম্মুখীন হয় মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর জ্যেষ্ঠপুত্র মহিমচন্দ্রের অকাল মৃত্যুর কারণে।ফলে আবার সাহিত্য সম্মিলন স্থগিত হয়ে যায়।
অতঃপর সম্মিলনের পরবর্তী তারিখ ঠিক হয় ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ১৭ই এবং ১৮ই কার্ত্তিক।সভার স্থান কাশিমবাজার রাজবাটী প্রাঙ্গণ। কাশিমবাজারে ১৭ই এবং ১৮ই কার্ত্তিক দিনটিতে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম প্রাণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার দরুন দিনটি আমাদের জেলাবাসীর কাছে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। এই সারস্বত সমাবেশে বঙ্গের প্রায় সকল জেলা থেকে আগত বঙ্গ সাহিত্যসেবীর উপস্থিতি এক ঐতিহাসিক ঘটনা। গ্রন্থকার, সাময়িকী ও সংবাদপত্র সম্পাদক, প্রকাশক বা অন্যরকম প্রতিনিধি, বক্তা, বিভিন্ন ধর্ম ও সাহিত্য সভার সম্পাদক ও সভাপতি, শিক্ষা বিভাগের সম্ভ্রান্ত প্রতিনিধি, ব্যবহারজীবী, মহারাজ, রাজা, ভূম্যাধিকারী, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শাস্ত্রানুশীলন কার্য্যে রত, স্বদেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ এবং প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোন সম্পর্ক ছিল তাঁরা সকলেই ঐ মহাযজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন।
কাশিমবাজার রাজবাটীর বিস্তৃত প্রাঙ্গণে নির্মিত সুসজ্জিত মঞ্চে আয়োজিত হয় এই ঐতিহাসিক সম্মেলন। মঞ্চ ও তোরণ সজ্জার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় তরুণ কবি ও চিত্রশিল্পী শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য।বঙ্গ প্রদেশের বিভিন্ন স্থান ও প্রদেশের বাইরে থেকে আগতদের থাকবার সুবন্দোবস্ত হয়েছিল রাজপ্রাঙ্গণের বিভিন্ন অংশের বাড়িগুলিতে। মহারাজার প্রত্যক্ষ তদারকিতে অতিথিদের খাতির-যত্নের কোন ত্রুটি ছিল না।অতিথিদের শহরের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের জন্য ও গঙ্গাস্নানের জন্য ঘোড়াগাড়ীর ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া অতিথিদের চা, পান, তামাক ইত্যাদি সরবরাহ করার জন্য ও নানাবিধ ফরমাস খাটার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মচারী ছিলেন।
এই ঐতিহাসিক সম্মেলনের বিশদ বর্ণনা দেওয়া প্রসঙ্গে তৎকালীন ‘জাহ্নবী’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত লিখেছেন-“সম্মেলনের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৭ই কার্ত্তিক ওই সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানানোর জন্য কাশিমবাজারের এক স্টেশন আগে বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে স্বেচ্ছাসেবকেরা উপস্থিত ছিলেন।ঠিক সকালেই কাশিমবাজার স্টেশনে ট্রেন ঢোকে। স্বেচ্ছাসেবক বালকবৃন্দ নিজেরাই ঘাড়ে করিয়া আমাদের ব্যাগ প্রভৃতি নামাইয়া গাড়ীতে তুলিয়া দিল। অনুমানে বুঝিলাম প্রায় ৬০-৭০ জন ডেলিগেট এ গাড়ীতে আসিয়াছেন। একখানি গাড়ীতে জনৈক স্বেচ্ছাসেবকের সহিত মহারাজের প্রাসাদে উপস্থিত হইলাম বেলা তখন আট ঘটিকা। মহারাজের তোরণ-নহবত তখন সুমধুর রাগিনী আলাপ করিতেছিল। স্বয়ং মহারাজ তাঁর তোরণদ্বারে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা করিলেন। ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে প্রস্তরের সুন্দর খিলান,পত্র,পুষ্প ও চাঁদোয়া...।”
অতঃপর সভার সভাপতি মাননীয় শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সভাপতির ভাষণে বললেন-“ বাংলা দেশের স্থানে স্থানে সাহিত্য পরিষদের শাখা স্থাপন ও বৎসরে বৎসরে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় পরিষদের বাৎসরিক মিলনোৎসব সাধনের প্রস্তাব অন্ততঃ দুইবার আমার মুখ দিয়া প্রচার হইয়াছে।অদ্যকার সভায় আমার নিবেদন এই সাহিত্য পরিষদের মধ্যে আপনারা সকলে মিলিয়া স্বদেশকে সত্য করিয়া তুলুন। বাংলা দেশের প্রত্যেক জেলা এবং প্রত্যেক বাঙালী সাহিত্য পরিষদের মধ্যে নিজের ইচ্ছা ও চেষ্টাকে একত্রে জাগ্রত করিয়া আজ যাহা অস্ফুট আছে তাহা স্পষ্ট করুন, যাহা ক্ষুদ্র তাহাকে মহৎ করুন...।”
"আজ বরিশাল ও বহরমপুর আমাদিগের আহ্বান করিয়াছেন, ইহাতে মনে মনে আশা হইতেছে, আমাদের বহুদিনের চেষ্টার সার্থকতা আসন্ন হইয়া আসিয়াছে।দীপশিখা জ্বালিবার দুইটা ব্যবস্থা আছে। তাহার প্রথম অবস্থা চকমকি ঠোকা। সাহিত্য পরিষদ কাজ আরম্ভ করিয়া প্রথম কিছুদিন চকমকি ঠুকিতেছিল, তাহাতে বিচ্ছিন্নভাবে স্ফুলিঙ্গ বাহির হইতেছিল। দেশে বুঝি তখনো পলিতা পাকানো হয় নাই। অর্থাৎ দেশের হৃদয়গুলি এক প্রান্ত পর্যন্ত এক সূত্রে পাকাইয়া ওঠে নাই।তারপরেই স্পষ্টই দেখিতেছি আমাদের দেশে হঠাৎ একদিন শুভদিন আসিয়াছে।...অতএব বিশেষ করিয়া বহরমপুরের প্রতি এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সমস্ত জেলার কাছে আজ আমাদের নিবেদন এই যে সাহিত্য পরিষদের চেষ্টাকে আপনারা আবিচ্ছিন্ন করুন।”- কবির এই আহ্বান পরবর্তীকালে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার বলিষ্ঠ প্রয়াস বলে মনে করা যায়।
সভাপতি রবীন্দ্রনাথের ভাষণের পর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রবীণ সম্পাদক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী তাঁর ‘সাহিত্য সম্মেলন ’ বিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাঁর প্রবন্ধ পাঠের পর ভাষা সংস্কার বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। প্রথম অধিবেশনে দুটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয় ও তা সমর্থিত হয়। বাঙ্গালার পুরাতত্ত্ব, ঐতিহাসিক উপকরণ, মুদ্রিত ও অমুদ্রিত প্রাচীন গ্রন্থ ও লৌকিক সাহিত্য সংগ্রহ বিষয়ে, প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যের উদ্ধার ও রক্ষা প্রচারের কথাও ছিল। প্রস্তাব দুটির স্বপক্ষে ব্যোমকেশ মুস্তাফী, যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ বসু, দুর্গাদাস লাহিড়ী, হরগোপাল দাস কুণ্ডু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সন্ধ্যার পর সঙ্গীতের আসর বসে। সন্ধ্যা ৬টায় প্রথম দিনের অধিবেশন শেষ হয়। এই দিন রাত্রে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
দ্বিতীয়দিনের অধিবেশনে মোট আটটি প্রস্তাব উত্থাপিত ও সমর্থিত হয়।ঐ দিন কিছু প্রবন্ধ সময়াভাবে পাঠ করা সম্ভব না হওয়ায় সম্মেলনের রিপোর্টের সঙ্গে প্রকাশ করার জন্য সভাপতি রবীন্দ্রনাথের হাতে অর্পণ করা হয়।১৭ই ও ১৮ই কার্ত্তিক অধিবেশন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে ১৯ শে কার্ত্তিক সকালে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত তরুণ সাহিত্যসেবীদের অনুরোধে স্বকন্ঠে গেয়ে শোনালেন “অয়ি ভুবন মনোমোহিনী” স্বরচিত গানখানি।পরে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুরোধে তাঁদের সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবি তোলেন।এরপর রবীন্দ্রনাথ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।জেলাবাসীর হৃদয়ে পরম যত্নে সঞ্চিত রইল সাহিত্য সম্মিলনের মধুর স্মৃ্তি।
এই সম্মেলনে আগত অন্যতম প্রতিনিধি ও সাহিত্যসেবী দুর্গাদাস লাহিড়ী সেদিন মন্তব্য করেছিলেন, “আজ থেকে শতবর্ষ পড়ে যদি কোন পর্যটক মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে আসেন তবে তিনি যেন একবার কাশিমবাজারের এই পবিত্র রাজপ্রাসাদ দর্শন ও প্রণাম করে যান।”
শতবর্ষ অতিক্রান্তে ১৪১৪ বঙ্গাব্দের পুণ্য বৈশাখের এক সন্ধ্যায় এই শতবর্ষপূর্বের প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনকে শ্রদ্ধা ও আবেগের সঙ্গে স্মরণ করলেন রবীন্দ্রমেলা, বহরমপুর, এক সুন্দর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ১লা মে, ২০০৭ সংখ্যায় লিখেছে, “প্রায় বিস্মৃত ওই ঐতিহ্য স্মরণ করাতে রবিবার সন্ধ্যায় ভগ্নপ্রায় ওই প্রাসাদের প্রাঙ্গণেই ফের বেজে উঠল মাঙ্গলিক গীতি –
“কবি মনোবিনোদিনী বাণী বরদে,
জ্যোৎস্না জাল বিকাশিনী শতদলবাসিনী সারদে...।”
উদ্যোক্তা বহরমপুর রবীন্দ্রমেলা কমিটি। হারিয়ে যাওয়া ওই ইতিহাস স্মরণ করাতে শতবর্ষ পর ভাঙাচোরা রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণে বক্তব্য রাখেন বহরমপুরের তিন বিশিষ্ট নাগরিক মৃণালকান্তি চক্রবর্তী, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত। রবীন্দ্রমেলা কমিটির সদস্যরা পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত,নজরুলগীতি,রজনীকান্ত,অতুলপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান ও আবৃত্তি।”
অতঃপর ১৪১৪ বঙ্গাব্দের ১৮ই কার্ত্তিক ওই স্মরণসভার সমাপ্তি অনুষ্ঠান হয় স্থানীয় ঋত্বিক সদন মঞ্চে বহু সুধীজনের উপস্থিতিতে। অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অধ্যাপক ডাঃ নির্মল দাস। এভাবেই রবীন্দ্রমেলা, বহরমপুর পালন করল এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকার :
১। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র-সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়
২।‘গণকন্ঠ’ বিশেষ সংখ্যা-১৯৮৬-সম্পাদক প্রাণরঞ্জন চৌধুরী
৩। History of the Cossimbazar Raj in the 19th Century-Vol.1-1986-Soumendra Chandra Nandy
৪। নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের রচনা (বিবরণ)।
৫। আনন্দবাজার পত্রিকা-১লা মে, ২০০৭ সংখ্যা।
![](https://static.wixstatic.com/media/c9f588_61802bd6097348b7a4ec9aefce3020bf~mv2.jpg/v1/fill/w_600,h_900,al_c,q_85,enc_avif,quality_auto/c9f588_61802bd6097348b7a4ec9aefce3020bf~mv2.jpg)
লেখক পরিচিতি
সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত, সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। সমাজসেবা ও বঙ্গীয় গ্রন্থাগার আন্দলনে যুক্ত।প্রবন্ধ লেখেন।
Comments