পামীর সর্বাধিকারী

“আগমনী” শব্দের অর্থ আগমন গাথা, বিশেষ করে দুর্গাদেবীর আগমনকে কেন্দ্র করে সংগীত।আসলে “আগমনী” শব্দটা শুনলেই কোথা থেকে যেন পরিবেশ ও প্রকৃতি আমায় ঘিরে ধরে।মনে আসে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর মায়াবী সূ্র্যালোক।নদীর তীর কাশে কাশে সাদা আর তাতে হাওয়ার লুটোপুটি।শিউলি ফুলের মন মাতানো গন্ধ, হিমেল হাওয়া আর সকাল বেলায় ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু আর মাঠ ভরা আমন ধানের ক্ষেতে বাতাসের ঢেউ। শরতের এ শোভা গোটা ভারতে একমাত্র এই বাংলায় প্রতীয়মান। আগমনীর এই বার্তা আমার হৃদয়ের গভীরেও বিশেষভাবে নাড়া দেয়। আজ সত্তর বছরের দোরগোড়ায় উপনীত হয়েও সেই অনুভূতি আমার অন্তরে বিরাজমান।তা হচ্ছে এই আবর্তে অদ্ভুত এক প্রেম উঁকি মারে জীবনের নানান মুহূর্তে। সবই যেন ভাল লাগে, সবাইকে ভাল লাগে একটু আন্তরিক ভাবে।অনেক কিছুই অব্যক্ত রয়ে যায় এই সময়ে। হয়তো আগমনীর মাহাত্ম্য এটা।আমার আগমনী আমার কাছে মিলনের বার্তা নিয়ে আসে, ছুটির আনন্দ নিয়ে আসে। উমার মর্ত্যলোকে পদার্পণ ঘিরে বাংলায় যে ধারাবাহিক মিলনোৎসব প্রতিপালিত হয় তা জাতপাতের সংকীর্ণতা ছাপিয়ে সকলকে একাত্ম করে মহামিলনের রূপ নেয়- এ আমার উপলব্ধি।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েও আমরা বহু বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ী শরতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আজও আগমনী গানের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি। এটা ভেবেও অবাক হই বর্তমান উত্তর আধুনিক কালের ছেলে মেয়েরা জেনারেশন গ্যাপের দোটানায় জর্জরিত হয়েও এই গানের প্রতি ঐতিহ্য পরম্পরায় একই আকর্ষণ অনুভব করে।যেমন আমরা বয়স্করা শৈশবে অনুভব করতাম। আসলে আগমনী গান মনের নিভৃতে এমন একটা অনুরণন সৃষ্টি করে যার আবেদন সময়ের গণ্ডীকে উপেক্ষা করে সর্বজনীন হয়ে ওঠে।আমাদের কৈশোরে পুজোর গান শারদ অর্ঘ্য ছিল আগমনী গান। আশ্চর্যজনক ভাবে শ্রোতারা আগমনী গানের কাঠামো, বিন্যাস ও গায়কী পরিবেশনার পরিবর্তন একেবারেই চান না। মহালয়া উপলক্ষে ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’ বা ‘জাগো দুর্গা দশপ্রহরণধারিনী’ যখন গীত হয় তখন মনটা মুহূর্তের মধ্যে একটা সুন্দর অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক বছর আগে বেতারে মহালয়া পরিবেশনায় কিছু পরিবর্তন করে কি কেলেঙ্কারিই না হয়েছিল। দুর্গাদেবীর মর্ত্যে আগমন উপলক্ষে রচিত ও পরিবেশিত আগমনী গান বাঙালী চিত্তকে ভক্তিরস সম্পৃক্ত বিশুদ্ধতায় উদ্ভাসিত করে তোলে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মা দুর্গা তার পিতৃদেবের গৃহে আগমন উপলক্ষে মানব সমাজ তাকে স্বাগত জানায় আর ভক্তি নিবেদন করে আর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে এই আগমনী গানে মাধ্যমে। মায়ের এই পিতৃগৃহে আগমনের সঙ্গে বাঙালী আটপৌরে বঁধুর ছেলে মেয়ে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে গ্রাম বাংলায় এই ধারা আজও বিদ্যমান।বাঙালী মানসকল্পে স্বর্গের উমা আমাদের সার্বজনীন মা হয়ে ওঠেন আর বাঙালীর সাধারণ জীবনচর্চার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান। সব ধরণের আগমনী গান বাঙালী মনের এই আবেশকে ধরে রাখে, ছুঁয়ে থাকে।
যে কোন আলাপচারিতার সমাপ্তি ঘটাতে গেলে শেষ সম্বল রবীন্দ্রনাথ।তাঁকে স্মরণ করা ছাড়া আমাদের আর আছে কী!কারণ তিনি সর্বক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। তাঁর রচিত শারদোৎসব নাটকটি আমায় বিশেষভাবে দোলা দেয়। টানা ১৮ ঘণ্টা জেগে ১৩২৯ বঙ্গাব্দে কবি এই নাটকটি রচনা করেন। এবং ওই বছর শারদোৎসব উপলক্ষে ছাত্রদের দ্বারা বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমে এটি অভিনীত হয়।রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে ছিলে ব্রাহ্ম, নিরাকারবাদী । কিন্তু পারিবারিকভাবে তাঁদের বাড়িতে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল যদিও দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরে সে ধারা লুপ্ত হয়। নিজে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েও বাঙালী পৌত্তলিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন এবং আবিষ্টও ছিলেন। তাঁর রচনায় সে প্রকাশ আছে।
শারদোৎসব নাটকে ব্যবহৃত আমাদের সকলেরর প্রিয় কয়েকটি গানের উল্লেখ করছি।‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি’ বা ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা’ অথবা ‘লেগেছে অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া’ –এই গানগুলি শুনলে শরতের এমন হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি কার না হয়। শরৎ তো আগমনীরই বার্তা আনে। তারপর ওই নাটকেরই গান ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা’ এই গানটিতেই আবার বলছেন ‘এসো গো শারদলক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে’। এই শারদলক্ষ্মী কবির কাছে আগমনীর প্রকাশ স্বরূপ।আসলে কবি বিশ্বাস করতেন পূজা যখন উৎসব হয়ে যায় তখন সেখানে ধর্মের আবহ আর থাকে না। থাকে শুধু আনন্দ আর ভালোবাসা। আর থাকে মিলনের বার্তা, মৈত্রীর বার্তা আর প্রীতির বন্ধন। আজকের সামাজিক অস্থির এই আবর্তে এই চেতনার প্রয়োজনীয়তা কতটা সেটা সকলের অনুমেয়।আবার এই নাটকেরই গান ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে’ –এই গানটাতেই আবার পরে লিখছেন ‘আকাশবীণার তারে তারে জাগে তোমার আগমনী’ । সেই আগমনীরই আবাহন। শারদোৎসব নাটকের ভিন্নতা এই যে, দেশের রাজা সম্পর্কে ভীতি তৈরি করে রাজা ও প্রজার মধ্যে অদ্ভুত এক ব্যবধান তৈরি করে রাখে রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাজা যদি আসন ছেড়ে প্রজাদের মধ্যে মিশে যেতে পারেন তবেই রাজার সার্থকতা। উৎসবই পারে এই ব্যবধান কিছুটা ঘোচাতে। আজকের দিনে সুস্থ গণতান্ত্রিক আবহ তৈরির স্বার্থে রাষ্ট্রপরিচালকদের এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার বার্তা এই নাটকে আছে। তাই রবীন্দ্রনাথ সদা প্রাসঙ্গিক বাঙালীর কাছে। আমরা সমাজে তাঁর ঐক্য ও মৈত্রীর সুবাস পৌঁছে দিতে চাই আগমনীর মাধ্যমে। যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ধ্বনিত-
'মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে-
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।।'

লেখক পরিচিতি
পামীর সর্বাধিকারী, রবীন্দ্রমেলার সদস্য।
Comments