top of page

কবির চিন্তায় মৃত্যুর নান্দনিকতা

সুপর্ণা দাস মজুমদার




অসীম প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যেমন বিশ্বস্বীকৃতি এনে দিয়েছেন, তেমনি তাঁর চিন্তার স্তরে স্তরে মানবকল্যাণের বিচিত্র দিকও প্রতিফলিত হয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে তিনি ধারণ ও লালন করেছেন। বালক বয়সে মায়ের মৃত্যু এবং কৈশোরে বন্ধুসম বৌঠান এবং পরবর্তীতে সন্তান ও স্ত্রীর অকালমৃত্যু এর মধ্যে অন্যতম। মৃত্যুর মতো বেদনাবহ ঘটনা যেখানে মানুষকে উল্টোপাল্টা করে দেয়, সেখানে আমাদের রবি কবি নিজেকে স্থির রেখেছিলেন। মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলে আহ্বান করেছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম প্রভাতে- ভানুসিংহের পদাবলীর 'স্মরণ কবিতায়ঃ" মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।''


কবির অধিকাংশ কবিতা ও গানে পরমাত্মায় নিবিষ্ট হওয়ার আকুতি প্রতিভাত হয়। তিনি বিশ্বতানকে জীবন গানে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি রচনা করেছেন দুঃখের গান যা শ্রবণে মানুষের মন অনন্তের পানে ধেয়ে যায়। আসলে জীবনকে আটকে রাখা যায় না- এই চরম সত্য কে বারবার নিজের উপলব্ধিতে এনে তিনি তাঁর রচনায় যে মৃত্যু দর্শনের চিত্র এঁকেছেন তা কালক্রমে হয়ে উঠেছে এক নান্দনিক জীবন দর্শন।


রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু নিয়ে অনেক ভেবেছেন। অল্প বয়স থেকেই মৃত্যুর কাতরতায় তিনি হাহাকার করেছেন, কিন্তু পরিণত বয়সে বিশেষ করে বিদায়ের কয়েক বছর পূর্ব থেকে মৃত্যু সম্বন্ধে বহু কবিতা লিখেছেন। সেখানে যে শুধু প্রশ্ন রয়েছে তা নয় মানুষের চির নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। কবির কথায় বেদনা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত করে তোলে।তিনি উপদেশ দিয়েছেন, মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হওয়া উচিত নয়। তাই রবীন্দ্র মানসে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার এই প্রত্যয় মূলত মৃত্যুচেতনায় সৌন্দর্য অবলোকনের নন্দিত প্রয়াস বলা যেতে পারে।


সারা জীবন ধরে একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাঁর পিছু ছাড়েনি, আর তিনিও মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়েননি। তিনি জীবনব্যাপী মানব জীবনের নানাদিক গভীরভাবে ভেবেছেন, আবার সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে তা প্রকাশ করেছেন। তবে মনে হয় তার এই মৃত্যুচিন্তা নানারকম দ্বান্দ্বিকতায় পূর্ণ।


রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপনিষদিক চিন্তা ভাবনায় পরিপূর্ণ। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় তাঁর সব চিন্তার মধ্যে লুকিয়ে আছে ঈশোপনিষদের দর্শনের মর্মবাণী - "ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যদকিঞ্চ জগতাং জগত'' অর্থাৎ এই গতিশীল বিশ্বে যা কিছু চলমান বস্তু আছে তা ঈশ্বর বাসের নিমিত্ত। তাই কবিতা-গান-প্রবন্ধ-গদ্যে এই দর্শনের অন্তর্গূঢ় রহস্য প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুকে তিনি আলিঙ্গন করেছেন পরম মমতায় বন্ধুরূপে। আবার অনন্ত জীবনের যাত্রাপথে পরমাত্মীয়ের মত নতুন নতুন জীবনপথের অনুসন্ধান দাতা হিসেবে উপলব্ধি করে বলেছেনঃ ''ওগো পথিক, দিনের শেষে

'এ যাত্রা তোমার কোন দেশে!

এপথ গেছে কোন খানে?'


রবীন্দ্রনাথ জীবন ও বিশ্বসৃষ্টির সুগভীর এই তাত্ত্বিক দর্শন পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করেছেন, রহস্যময়তায় অনন্যসাধারণ শিল্পময়তার মাধ্যমে। সেই কারণেই মৃত্যুচিন্তার ভেতর থেকেও মৃত্যুর নান্দনিক দিকটির উন্মোচন ঘটিয়েছেন।


রবীন্দ্রনাথ সুখের মত দুঃখকেও স্বাগত জানিয়েছেন, আবার স্বাগত জানিয়েছেন জীবনের মতো মৃত্যুকেও। আসলে তার প্রেক্ষণবিন্দুতে ছিল মৃত্যু দর্শনের বোধ। রবীন্দ্রনাথ এই মৃত্যু যাপনের অতলস্পর্শী হৃদয়মুখরতার গাম্ভীর্য থেকে খুঁজে এনেছেন মহিমান্বিত নান্দনিকতা। তাই কবির মতে জীবন দর্শনের মতো মৃত্যুদর্শনও গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি মাধুর্যমন্ডিত ক্ষণেই তিনি অনিবার্য শূন্যতাকে পরম মমতায় আলিঙ্গন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি মানব কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন বলেই হয়তো স্বজন বিয়োগের বেদনা বা মৃত্যুবেদনা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তিনি বলেছেন

''মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুরই রূপ

দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,

তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ, আপনার পানে চাই।''


কবির ভাবনায় মৃত্যু কখনও প্রণয়ী, বাউল, কখনও বধূর স্বামীর বধুর স্বামী বেশে, বন্ধুরূপে জীবনরথের সারথি হয়ে, অন্ধকারে ধ্যাননিমগ্ন অবগুণ্ঠনের আবরণ পরে ললিতমোহন সাজে ধরা দিয়েছে। মৃত্যুর সৌন্দর্য আস্বাদন করে তিনি সেই পরম উপলব্ধির স্বরূপ ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতায়-গানে -সাহিত্যের নানা শাখায়।


তবে এতকিছুর পরেও প্রশ্ন জাগে, মৃত্যু যদি সবার জীবনে বিনাশ সাধনই ঘটাবে তাহলে জীবন থেকে জীবনান্তরের পথে চলার আনাগোনা কেমন করে সম্ভব? তাই বিনাশ সাধন নয়, নিরন্তর চলার জন্যই মৃত্যুর স্পর্শলাভে দেহের খোলস বদলে যায় বারবার। আর এরই খোলস বদলের মাধ্যমেই সম্ভব হয় নানা রূপ পরিগ্রহের-যার সার্থক উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথে।বিদায় তাকে নিতে হবে জেনেও তিনি ভালোবাসার সামনে দাঁড়িয়ে লিখেছেনঃ

"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,

তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অন্তত জাগে।"


লেখিকা পরিচিতি

সুপর্ণা দাস মজুমদার, বহরমপুর রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page