top of page

কবির জীবনবোধে বাংলার ঋতু

অনির্বাণ দাস




ঋতুরঙ্গের কবি রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ-ভাবনা তাঁর জীবন বোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত।তিনি তাঁর অনুভবের ‘জীবন-দেবতা’ বা ‘বিরাট পুরুষের’ সাথে প্রকৃতিকে মিলিয়ে দেখেছেন।তাই প্রকৃতি অনেকটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে এসে অনিত্য নিত্যের মধ্যে জায়গা করে আনন্দলোকের সন্ধান দেয়।

রবীন্দ্র মননে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের বিচিত্ররূপ, প্রকৃতির শূন্যতা, ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব, আলো-ছায়ার ছবি নানা রং-এ নানা রূপে হাজির হয়েছে।

“ঋতুতে ঋতুতে যে ভেদ সে কেবল বর্ণের ভেদ নহে, বৃত্তিরও ভেদ বটে। মাঝে মাঝে বর্ণসংকর দেখা দেয়--জ্যৈষ্ঠের পিঙ্গল জটা শ্রাবণের মেঘস্তূপে নীল হইয়া উঠে, ফাল্গুনের শ্যামলতায় বৃদ্ধ পৌষ আপনার পীত রেখা পুনরায় চালাইবার চেষ্টা করে।”১ তিনি গ্রীষ্মকে বলেছেন ব্রাহ্মণ। বর্ষাকে ক্ষত্রিয়। শীতকে বৈশ্য।আর হেমন্ত, শরৎ ও বসন্তকে তুলনা করেছেন শুদ্রের সঙ্গে।

“গ্রীষ্মকে ব্রাহ্মণ বলা যাইতে পারে। সমস্ত রসবাহুল্য দমন করিয়া, জঞ্জাল মারিয়া, তপস্যার আগুন জ্বালিয়ে সে নিবৃত্তিমার্গের মন্ত্র সাধন করে। সাবিত্রী-মন্ত্র জপ করিতে করিতে কখনো বা সে নিশ্বাস ধারণ করিয়া রাখে, তখন গুমটে গাছের পাতা নড়ে না; আবার যখন সে রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়িয়া দেয় তখন পৃথিবী কাঁপিয়া উঠে। ইহার আহারের আয়োজনটা প্রধানত ফলাহার।”১

শান্তিনিকেতনের একটি ঘটনা।দারুন গ্রীষ্ম। বেলা নটা বাজতে না বাজতেই দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়েও স্বস্তি পায় না লোকে। হাতপাখা ভিজে ঠাণ্ডা জল কিছুতেই আর রক্ষে নেই।উত্তরায়নে কবি আছেন।উত্তর দিকের দরজা জানালা খোলা। গরম হাওয়া হাওয়া এসে ঝলসে দিচ্ছে ঘরের ভেতরটা। গুরুদেব বসে বসে একমনে লিখে চলেছেন। গায়ে মোটা কাপড়ের জোব্বা। গরম লাগে কিনা জানতে চাইলে, হেসে বলতেন, গরম না লাগার জন্যই তো মোটা জোব্বা গায়ে দিয়েছি। গরম লাগে কেন? গরম হওয়াটা গায়ে এসে লাগে বলেই তো! মোটা কাপড় দিয়ে গাটা ঢেকে দাও। গরম হওয়া আর গায়ে লাগবে না।২

জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন যে, জীবনের এক একটা পর্যায়ে এক একটা ঋতু বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তিনি বলেছেন, “বাল্যকালের দিকে তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি। বাতাসের বেগে চলের ছাঁটে বারান্দা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারীবুড়ি কক্ষে একটা বড়ো ঝুড়িতে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকাদা ভাঙিয়া আসিতেছে, আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় প্রবল আনন্দে ছুটিয়া বেড়াইতেছি। আর মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরমায়-ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে; অপরাহ্নে ঘনঘোর মেঘের স্তূপে স্তূপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে; দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি নামিয়া আসিল; থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ-ডাকার শব্দ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের নখ দিয়া এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন্‌ পাগলি ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিতেছে; বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙিয়া পড়িতে চায়; অন্ধকারে ভালো করিয়া বইয়ের অক্ষর দেখা যায় না-- পণ্ডিতমশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন;...”৩ এই বোধ কবির অন্তরে, তাই তো পোস্টমাস্টার- লিখলেন, " একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ- তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল; রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উত্থিত হইতেছিল; মনে হইতেছিল, যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিঃশ্বাস গায়ের উপর আসিয়া লাগিতেছে...।ঘন বরষায় পরে থাকতেন তিনি গাঢ় নীল রঙের জোব্বা। এইরূপই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। মেঘ দেখতে পেলে কি খুশি হতেন!

“বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষ হয় না। তাহার নকিব আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে,--মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্বিজয় করাই তাহার কাজ। লড়াই করিয়া সমস্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিক্‌চক্রবর্তী হইয়া বসে। তমালতালী-বনরাজির নীলতম প্রান্ত হইতে তাহার রথের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, তাহার বাঁকা তলোয়ারখানা ক্ষণে ক্ষণে কোষ হইতে বাহির হইয়া দিগ্‌বক্ষ বিদীর্ণ করিতে থাকে, আর তাহার তূণ হইতে বরুণ-বাণ আর নিঃশেষ হইতে চায় না। এদিকে তাহার পাদপীঠের উপর সবুজ কিংখাবের আস্তরণ বিছানো, মাথার উপরে ঘনপল্লবশ্যামল চন্দ্রাতপে সোনার কদম্বের ঝালর ঝুলিতেছে, আর বন্দিনী পূর্বদিগ্বধু পাশে দাঁড়াইয়া অশ্রুনয়নে তাহাকে কেতকীগন্ধবারিসিক্ত পাখা বীজন করিবার সময় আপন বিদ্যুন্মণিজড়িত কঙ্কণখানি ঝলকিয়া তুলিতেছে।”১

“এই জন্য বর্ষা-ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু। কেননা কবি গীতার উপদেশকে ছাড়াইয়া গেছে। তাহার কর্মেও অধিকার নাই; ফলেও অধিকার নাই। তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে;--কর্ম হইতে ছুটি, ফল হইতে ছুটি।

বর্ষা ঋতুটাতে ফলের চেষ্টা অল্প এবং বর্ষার সমস্ত ব্যবস্থা কর্মের প্রতিকূল। এইজন্য বর্ষায় হৃদয়টা ছাড়া পায়।”১

সেবার খুব গরম পড়েছে।শান্তিনিকেতনে গুরুদেবকে সে গরম বেশ জানান দিয়ে ছাড়ে। সে সময় কষ্ট হতো তার শান্তিনিকেতনে থাকতে অথচ তিনি আশ্রম ছেড়ে যেতে চাইতেন না বাইরে। বলতেন, কদিনই বা! দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তারপরে তো বর্ষা শুরু হবে, দিগন্তজুড়ে কালোমেঘ এগিয়ে আসবে, বাইরে চলে গেলে দেখতে পাব না যে!

একবারের ঘটনা। প্রচন্ড গরম পড়লো শান্তিনিকেতনে, এদিকে দারুন অনাবৃষ্টি। মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। দিগন্তে হাওয়া। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ কাটলো। বর্ষা এই আসে এই আশায় আশায় দিন কাটাতে লাগলেন গুরুদেব। একদিন এমন হয় মেঘ করে আসে, আকাশে গুরু গুরু গর্জন করে কিন্তু কোন করুণা করে না। শেষ পর্যন্ত আশ্রম-এর উপর দিয়েই মাঠ পেরিয়ে চলে যায় দূরে কালোমেঘ প্রতি অবহেলায়। সবাই চেয়ে থাকে আকাশের দিকে যে আজ বৃষ্টি হবেই।মেঘের পরে মেঘ হয়ে আসছে, এগিয়ে এলো এল, এই পড়ল আগ্রহে উল্লাসে ছোটাছুটি করে সবাই অঙ্গনে। খানিক পরেই মলিনমুখে ঘরে ঢুকে পড়ে সবাই। প্রহসনই চলতে থাকলো এদিকে গুরুদেব কালিংপং যাবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে হবে বিকেলে ট্রেন।গুরুদেব যাবেন কলকাতায়। মালপত্র মানুষ সব চলে গেছে স্টেশনে। গুরুদেব তৈরি হয়ে বসে আছেন। তখন ফোন ছিল না। ট্রেন ঠিক সময়ে আসছে কিনা খবর জানতে সেসময় ষ্টেশনে যেতে হতো। সময় হয়েছে। এবার গুরুদেব মোটরে উঠবেন। গুরুদেব মোটরে উঠে রওনা হলেন। গুরুদেব তখন উদিচীতে থাকতেন। আর রানি চন্দরা থাকতেন কোনার্কে। গুরুদেব কে তুলে দিয়ে ফিরে এসে রানী চন্দ কোণার ছাদে পায়চারি করছেন।দেখা যাচ্ছে ঈশানকোণে তাল গাছের সারি, তারপরে তালতোড়গ্রাম। তার ওধারে কোপাই স্টেশন থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ট্রেন আসছে। এগিয়ে এসে মাঠের ধারে মাটি কেটে নিচে ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর দেখা যায় না। এবার বোলপুর। গুরুদেব চলে যাচ্ছেন। হঠাৎ মোটরের আওয়াজ। গুরুদেবের সেই মোটরখানাই তো ঢুকছে উত্তরায়নের গেট দিয়ে। ভেতরে কি সেই ঘন নীল গুরুদেবের জোব্বা? তবে কি? একছুটে ছাদ থেকে নেমে এলেন রানী চন্দ। গাড়ি ততক্ষনে এসে দাঁড়িয়েছে উদীচীর সামনে। দরজার হাতল ধরে গেট খুলে দেখলেন গুরুদেব গাড়ির ভেতর বসে। গুরুদেব হাসতে লাগলেন, বললেন, দেখ গিয়ে এতক্ষণে কি হলো? আমার সেক্রেটারি হয়তো ট্রেনে এ মাথা ও মাথায় ছুটোছুটি আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে আর আমি পালিয়ে এসেছি। পরের গল্প শোনা গেল। গুরুদেব গেলেন, গিয়ে যেমন প্রতিবারে করেন, ছোট গেটের সামনে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ট্রেন এল। সবাই ব্যস্ত জিনিসপত্র ট্রেনে ওঠাতে। সবকিছু উঠে গেলে তবে গুরুদেব উঠবেন। এমন সময় আকাশের দিকে দেখলেন এক কোনায় এক টুকরো কালো মেঘ এগিয়ে আসছে যেন। অমনি ড্রাইভারকে বললেন, মোটর ঘোরাও, ফিরে এলেন। সেই মেঘ কিন্তু বর্ষালো না।২

“শরতে হেমন্তে ভরা-মাঠ ভরা-নদীতে মন নাচিয়া ওঠে; তখন উৎসবেরও অন্ত নাই, কিন্তু রাগিণীতে তাহার প্রকাশ রহিল না কেন? তাহার প্রধান কারণ, ওই ঋতুতে বাস্তব ব্যস্ত হইয়া আসিয়া মাঠঘাট জুড়িয়া বসে। বাস্তবের সভায় সংগীত মুজরা দিতে আসে না--যেখানে অখণ্ড অবকাশ সেখানেই সে সেলাম করিয়া বসিয়া যায়।”১

শরতের অমল আলোয় রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি, সেই আলোছায়া তাকে মোহিত করে রাখতো। “শরতের রংটি প্রাণের রং। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড়ো নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা। এইজন্য শরতে নাড়া দেয় আমাদের প্রাণকে,...”৪ কত সময় তিনি বলতেন, এই যে শিমুলের কচি পল্লবে আলো পড়েছে, পাতাগুলি হাওয়ায় দুলছে, কি সুন্দর লাগছে। ঢাকা বারান্দায় বসে দেখতেন আর বলতেন, দেখ দেখ, এই যে সোনার আলো পড়েছে উদয়নের উপর, কে যেন সোনার কাঠি দিয়েছে। উদয়নের এগিয়ে আসা পিছিয়ে যাওয়ায় দেওয়ালে দেওয়ালে আলো ছায়ার খেলায় সে এক রূপকথার রাজবাড়ী হয়ে গিয়েছে। তার রূপের বাহার গুরুদেব বিস্মিত হয়ে বলে চলেছেন, একটা আনন্দ যাচ্ছে না প্রাণের ভেতরে!

কবি বলেছেন, “এই শরৎকালের মধ্যে আমি একটি নিবিড় গভীরতা, একটি নির্মল নিরতিশয় আনন্দ অনুভব করি। এই প্রথম বর্ষা অপগমে প্রভাতের প্রকৃতি কী অনুপম প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করে। রৌদ্র দেখিলে মনে হয় যেন প্রকৃতি কী এক নূতন উত্তাপের দ্বারা সোনাকে গলাইয়া বাষ্প করিয়া এত সূক্ষ্ম করিয়া দিয়াছেন যে, সোনা আর নাই কেবল তাহার লাবণ্যের দ্বারা চারি দিক আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। বায়ু-হিল্লোলের মধ্যে একটি চিরপরিচিত স্পর্শ প্রবাহিত হইতে থাকে, কাজকর্ম ভুলিয়া যাইতে হয়; বেলা চলিয়া যাইতেছে, না মন্ত্রমুগ্ধ আলস্যে অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছে, বুঝা যায় না। শরতের প্রভাতে যেন আমার বহুকালের স্মৃতি একত্রে মিশিয়া রূপান্তরিত হইয়া রক্ত আকারে আমার হৃদয়ের শিরার মধ্যে সঞ্চারম করিতে থাকে।”৫

“শরৎ বড়ো বড়ো গাছের ঋতু নয়, শরৎ ফসলখেতের ঋতু। এই ফসলের খেত একেবারে মাটির কোলের জিনিস। আজ মাটির যত আদর সেইখানেই হিল্লোলিত, বনস্পতি দাদারা একধারে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া তাই দেখিতেছে।

এই ধান, এই ইক্ষু, এরা যে ছোটো, এরা যে অল্পকালের জন্য আসে, ইহাদের যত শোভা যত আনন্দ সেই দুদিনের মধ্যে ঘনাইয়া তুলিতে হয়। ”৪ কিংবা “আমাদের শরতে আগমনীটাই ধুয়া। সেই ধুয়াতেই বিজয়ার গানের মধ্যেও উৎসবের তান লাগিল। আমাদের শরতে বিচ্ছেদ-বেদনার ভিতরেও একটা কথা লাগিয়া আছে যে, বারে বারে নূতন করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়--তাই ধরার আঙিনায় আগমনী-গানের আর অন্ত নাই। যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরাইয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড়ো উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়ার উৎসব।”৪

“আর শীতটা বৈশ্য। তাহার পাকাধান কাটাই-মাড়াইয়ের আয়োজনে চারটি প্রহরব্যস্ত, কলাই যব ছোলার প্রচুর আশ্বাসে ধরণীর ডালা পরিপূর্ণ। প্রাঙ্গনে গোলা ভরিয়া উঠিয়াছে, গোষ্ঠে গোরুর পাল রোমস্থ করিতেছে, ঘাটে ঘাটে নৌকা বোঝাই হইল, পথে পথে ভারে-মন্থর হইয়া গাড়ি চলিয়াছে; আর ঘরে ঘরে নবান্ন এবং পিঠাপার্বণের উদ্যোগে ঢেঁকিশালা মুখরিত।”১

“এই তিনটেই প্রধান বর্ণ। আর শূদ্র যদি বল সে শরৎ ও বসন্ত। একজন শীতের, আর একজন গ্রীষ্মের তলপি বহিয়া আনে। মানুষের সঙ্গে এইখানে প্রকৃতির তফাত। প্রকৃতির ব্যবস্থায় যেখানে সেবা সেইখানেই সৌন্দর্য, যেখানে নম্রতা সেইখানেই গৌরব। তাহার সভায় শূদ্র যে, সে ক্ষুদ্র নহে, ভার যে বহন করে সমস্ত আভরণ তাহারই। তাই তো শরতের নীল পাগড়ির উপরে সোনার কলকা, বসন্তের সুগন্ধ পীত উত্তরীয়খানি ফুলকাটা। ইহারা যে-পাদুকা পরিয়া ধরণী-পথে বিচরণ করে তাহা রং-বেরঙের সূত্রশিল্পে বুটিদার; ইহাদের অঙ্গদে কুণ্ডলে অঙ্গুরীয়ে জহরতের সীমা নাই।”১

“ছেলে বেলায় বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে যখন ছাদে পড়ে থাকতুম তখন জ্যোৎস্না যেন মদের শুভ্র ফেনার মতো একেবারে উপচে পড়ে নেশায় আমাকে ডুবিয়ে দিত।” এই অনুভব কবিকে সারা জীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে।

একদিনের ঘটনা।শীত সবে যাব যাব করছে। এক বিকেলে গুরুদেব বাসন্তী রঙের জামা পড়ে বাইরে বসে আছেন।জিজ্ঞেস করলে গুরুদেব হেসে বলেন, বসন্তের আসার সময় হল!যে আমি যদি তাকে ডেকে না আনি কে আনবে বল? তাইতো বাসন্তী রং পরে এসে বসন্ত কে আহবান করছি। একটু আগে এক পলকের জন্য দক্ষিণ হাওয়া পরশ বুলিয়ে গেল। লিখেছিলাম, উঠে জোব্বা বদলে নিলাম।২

কবির জবানিতে, “শরতের নীল পাগড়ির উপরে সোনার কলকা, বসন্তের সুগন্ধ পীত উত্তরীয়খানি ফুলকাটা।... শরতে তাহা চোখ জুড়াইয়া নবীন বেশে দেখা দেয়, হেমন্তে তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাকে, আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণত রূপে সঞ্চিত হয়।... শরৎ-হেমন্ত-শীতে মানুষের ফসলের ভাণ্ডার, সেইজন্য সেখানে তাহার তিন মহল; ওইখানে তাহার গৃহলক্ষ্ণী। আর যেখানে আছেন বনলক্ষ্ণী সেখানে দুই মহল,--বসন্ত ও গ্রীষ্ম। ওইখানে তাহার ফলের ভাণ্ডার, বনভোজনের ব্যবস্থা। ফাল্গুনে বোল ধরিল, জ্যৈষ্ঠে তাহা পাকিয়া উঠিল। বসন্তে ঘ্রাণ গ্রহণ, আর গ্রীষ্মে স্বাদ গ্রহণ।”১


তথ্যসূত্রঃ

১) পরিচয়-আষাঢ় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২) গুরুদেব- শ্নীরানী চন্দ

৩) বর্ষা ও শরৎ- জীবনস্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৪) পরিচয়- শরৎ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৫) বিবিধ - শরৎকাল - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


লেখক পরিচিতি

অনির্বাণ দাস, রবীন্দ্রমেলার সদস্য

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page