top of page

ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথ

গার্গী মুখার্জী

(রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত জীবনে ঠাকুর বাড়ির প্রভাব)



ঠাকুরবাড়ির কথা যেমন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অসম্পূর্ণ, রবীন্দ্রনাথের জীবনের কথাও তেমনই ঠাকুরবাড়ি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। শুধু সম্পূর্ণ হয় না বললেও হয়তো ভুল বলা হয় বরং বলা ভালো ঠাকুর বাড়ি ও রবীন্দ্রনাথ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ঠাকুর বাড়ির কথা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কথা শুরুই করা যায় না। অন্যভাবে বলা যায় ঠাকুর বাড়ির সিঞ্চিত রসামৃত না পেলে শিশু রবি একদিন মহীরুহ হয়ে উঠতে পারতেন না। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ, পরিজন, শিক্ষাদীক্ষা, চালচলন, হাবভাব, আত্মীয়কুটুম্ন, অতিথি, শিক্ষক সকলের প্রভাবেই প্রভাবিত ছিলেন আমাদের রবিঠাকুর, যার প্রকাশ ঘটে তাঁর রচিত সাহিত্যে, সঙ্গীতে', রচনায়, নাটকে।

রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই কলকাতার ঠাকুরবাড়ি ছিল উদার শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র। তাঁর সময়েই স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই দেশিবিদেশি শিক্ষারধারা অব্যাহত ছিল এই পরিবারে। দেশী উচ্চাঙ্গসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীত উভয় প্রভাবেই প্রভাবিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা তথা রাজা রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।

রবীঠাকুরের পরিবার সামগ্রিকবভাবেই এক বিশেষ বনেদিয়ানার অধিকারী ছিল। এই পরিবারের মহিলা ও পুরুষদের কথা বলার ভাষায় ছিল এক বিশেষ ভঙ্গী। বেশভূষায় ছিল আভিজাত্যের গর্ব। পুরুষের পোশাক ছিল পাজামা, আচকান চোগা চাপকান তাজ পাগড়ি। গৃহসজ্জায় ছিল জাজিম, ফরাশ, মছলন্দ , তাকিয়া,আলবোলা। আদবকায়দায় এঁরা ছিলেন মোগলাই। এর সঙ্গে কবির আমলে মিশে ছিল ইউরোপীয় সাজসজ্জা।

দ্বারকানাথের পুত্র তথা রবীন্দ্রনাথের পিতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তাঁর পুত্র কন্যাদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার এক বিশেষ পরিবেশ তৈরি হয়, যার ফলে তাঁদের মধ্যে প্রায় সকলেই সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের প্রতিভার পরিচয় রেখে যান। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

দেবেন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন সংগীতের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাঁর ঈশ্বরভক্তি ছিল অগাধ। রাজা রামমোহন রায়ের প্রভাবে১৮৪৩ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তাই ব্রহ্মোপাসনার গান দেবেন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন সময় রচনা করেছেন। রবিঠাকুরও তার ব্যতিক্রমী নন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবিঠাকুরের বড়দাদা, যাঁর সঙ্গীত চর্চা বালক রবির মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বাঁশি, অর্গানে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। আকারমাত্রিক স্বরলিপির পথ প্রথম তিনিই দেখিয়েছিলেন।

মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, ঠাকুরবাড়ির উপাসনা সঙ্গীতের সাথে বিলাতি অর্গান বাজাতেন। তিনিই প্রথম হিন্দী গান ভেঙে ব্রহ্মসংগীত রচনা করেন। তাঁর কন্যা ইন্দিরা দেবির জন্য ইউরোপীয় ও ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল ছোটো থেকেই।

মহর্ষির তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাধক। তাঁর কন্যা প্রতিভা দেবিও ছোটো থেকেই ইংরাজি ও হিন্দুস্থানী সংগীতে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠে।

মহর্ষির পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। আকারমাত্রিক স্বরলিপি পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের অনেকক্ষেত্রেই তাঁর জ্যোতিদাদাকে শিক্ষাগুরু মেনেছেন।

সোমেন্দ্রনাথ, মহর্ষির সপ্তম পুত্র, ছিলেন একজন সুগায়ক। রবিঠাকুরের জীবনের অগ্রগতির প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন আন্তরিক উৎসাহদাতা।

রবীন্দ্রনাথের মতে তাঁর কাব্যরচনার বিজ্ঞাপনের ভার নিয়েছিলেন সোমেন্দ্রনাথ।

ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যের মতো, রবিঠাকুর প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তিনি জীবনস্মৃতিতে বলেছেন 'আমাদের পরিবারে গানচর্চার মধ্যেই শিশুকাল হইতে আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না'। তাঁহাদের বাড়িতে বড় বড় ওস্তাদেরা প্রায়শই আমন্ত্রিত থাকতেন, কখনো কখনো তাঁরা গৃহশিক্ষক রূপে নিযুক্তও হতেন।

এমনই গৃহশিক্ষক রূপে তিনি পেয়েছেন বিষ্ণু চক্রবর্তী, শ্রীকন্ঠ সিংহ, যদু ভট্টকে। বিষ্ণ চক্রবর্তী ছিলেন রবির প্রথম সংগীত গুরু। নিতান্ত পাড়াগেঁয়ে ছড়ার মাধ্যমে রবি তাঁর থেকে দেশি গান শিখতে শুরু করেন, কিছু ব্রহ্মসংগীত ও শিখেছিলেন। শ্রীকন্ঠ বাবুর জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর "ছেলেবেলা" তে বলেছেন " তিনি তো গান শেখাতেন না, গান তিনি দিতেন, কখন তুলে নিতুম জানতে পারতুম না।"।

তবে যদুভট্ট ছিলেন বড় মাপের ওস্তাদ। তিনি রবিকে গান শেখাবেনই বলে জিদ ধরেছিলেন, তাই তাঁর থেকে রবির সেভাবে গান শেখাই হয়ে ওঠে নি। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু সংগ্রহ করেছিলেন বলে রবি তাঁর "ছেলেবেলা"তে জানিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত ও সাহিত্য জীবনে ঠাকুর বাড়ির বন্ধুস্থানীয় দুই জনের প্রভাবও অনস্বীকার্য। অক্ষয় চৌধুরী ও বিহারীলাল চক্রবর্তী।

একসময়ে রবিঠাকুর শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছেন কিশোরী চাটুজ্যেকে, যাঁর পাঁচালী গান রবির জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এছাড়াও রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, মৌলাবক্স, শ্যামসুন্দর মিশ্র প্রভৃতি গুণীজনের প্রভাবও রবির জীবনে অস্বীকার করা যায় না। এঁদের অনেকেই ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার অনুসারী। তাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত জীবনে বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রভাব অনস্বীকার্য।

ঠাকুর বাড়িতে তিনি যেমন শুনেছেন বড় বড় ওস্তাদদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, বিদেশি সঙ্গীত তেমনি শুনেছেন নানারকম লোকের নানাশ্রেণির গান, দাসদাসী, কর্মচারী, ভিখারি, বাউল, মাঝিমল্লার কন্ঠের গান। পরবর্তীতে সেই সকল সুরের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে রবিঠাকুরের সৃষ্টিতে। আর তাঁর সৃষ্টির বিপুল সম্ভার হয়ে উঠেছে আমাদের অমূল্য সম্পদ।



লেখিকা পরিচিতি

গার্গী মুখার্জী, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page