
নভেম্বর-৩, ২০০৮ :-
৩য়বার অ্যালার্মটা বাজবার পর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বিছানায় উঠে বসলাম, ঘড়ির কাটা ১০টার ঘরে। ঘুম থেকে উঠেই মনের ভিতরে কে যেন বলে উঠল উফ আবার একটা বিরক্তিকর দিন শুরু হল। বেশী কিছু ভেবে ওঠার আগেই দরজায় ধাক্কা পড়তে শুরু হয়ে গেছে আর সাথে মায়ের সেই চিরাচরিত অভিযোগ - এত দেরী করে উঠলে সমস্ত কাজ দেরীতে শুরু হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিরক্তির সাথে সাথে হাসিও পেল। গত দশ বছর ধরে আমি নিজের ঘুম থেকে উঠাটা যেমন একই রেখেছি, একই কথা ভাঙা টেপ রেকর্ডারের মত বাজিয়ে যাওয়াটাও মা তেমনি অব্যাহত রেখেছে। অবশেষে ঘর খুলে বেরিয়ে সবে বাথরুমে ঢুকেছি আবার সেই অস্বস্তিটা শুরু হয়ে গেল। ইচ্ছে করল জোরে দাবড়ানি দিয়ে বন্ধ করে দিতে, কিন্ত আমার নিজের ইচ্ছার যে কিছুই হয় না। ঘুম ভাঙল তো কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলা শুর হয়ে গেল। প্রিয় চা টা খাবার সময় একটু সাবধানে খাস, অল্প চুমুক দিয়ে দেখবি স্বাদটা অন্যরকম লাগছে কিনা। যদি কিছু সন্দেহ হয় পুরো চা টা কিন্তু ফেলে দিস।
নভেম্বর-৫, ২০০৮ :-
আগেকার দিনে মা বাবা অথবা দাদু দিদিমারা বাচ্ছা জন্মাবার পরেই তার জন্মক্ষণ, তারিখ ইত্যাদি নিয়ে দ্বারস্থ হতেন জ্যোতিষীর কাছে কোষ্ঠী গণনা করার জন্য। যথারীতি আমার জন্মের পরও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
বড় হয়ে যখন শুনতাম যে আমার কোষ্ঠীতে আছে আমি সংগীতে পারদর্শী হব আর সাহিত্যিক হবার সম্ভবনা আছে, তখন নিজের অবচেতনে সেই আশাগুলোকেই বোধহয় লালন করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার কবিতা লেখার খুব সখ। যখন আমার বন্ধুরা ফুটবল, ক্রিকেট খেলছে সেই সময় আমি হয়ত বাবার কাছ থেকে পাওয়া ডায়রীটাতে ছন্দ মিলিয়ে ছড়া লিখে চলেছি। সেগুলো পরবর্তীকালে কখনও যদি নজরে পড়ত অবাক হতাম ভেবে যে এ টুকু বয়সে আমি কত সুন্দর মনোসংযোগ করতে পারতাম, ভাবতে পারতাম। কিন্তু আজকাল কোন বিষয়েই আমি উৎসাহ পাই না। কোন কিছুতে মন বসাতে গেলেই মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা দানা বেঁধে ওঠে।
সিনেমায় যেমন একটার পর একটা দৃশ্য আসতে থাকে আমার মনেও তেমনি একটার পর একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা ভিড় করে আসে। মাঝে মাঝে এদের মধ্যে কোন যোগই থাকে না- অনেকক্ষণ পরে খেয়াল হয় আমি চুপচাপ জানলার দিকে তাকিয়ে বসে আছি - কখন বেশ কয়েকঘন্টা কেটে গেছে-হাতের কাজটা কিছুই করা হয়ে ওঠে নি। মা বকাবকি করে আমার এই অন্যমনস্কতার জন্য। কিন্তু আমি যেন ক্রমশঃ এই অন্যমনস্কতার জগতে তলিয়ে যাচ্ছি। আজাকাল রাত্রে ভাল ঘুম হয় না, মাঝে মাঝে চমকে উঠি। মনে হয় আবার সেই ফিসফিসে আওয়াজটা শুরু হয় যাবে। এই আওয়াজটা যে কার বুঝতে পারি না - প্রথম প্রথম ভাবতাম কেউ আমার সাথে মজা করছে নিশ্চয় ঘরের কোথাও একটা টেপরেকর্ডার লাগিয়ে রেখে। কিন্তু বহুবার দরজা বন্ধ করে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি। কোথাও কোন রেকর্ডারের চিহ্ন মাত্র নেই।
ডিসেম্বর-১৫, ২০০৮:-
আজকাল বড় বেশী আলসেমী লাগে। কোন কাজ করতে ইচ্ছা হয় না - ছোটবেলার সেই লেখার স্বভাবটা কবেই চলে গেছে শুধু রয়ে গেছে এই ডায়রী লেখার অভ্যাসটা-জানিনা এটাও কতদিন থাকবে। আসলে ডায়রী লিখলে মনে হয় যেন নিজেই নিজের সাথে কথা বলছি। মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, মনে হয় ডায়রীর পাতাটা একজনের মুখ, সে আমার দিকে চেয়ে আছে, চোখের পলক পড়ে না, কোন এক অজানা শক্তিতে সে আমাকে সন্মোহিত করে আমার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো যেন আমাকে দিয়েই বলিয়ে নিচ্ছে।
আজকাল মনের মধ্যে একটা ভয় হতে থাকে। যতই সেটাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি, পারি না, মনে হয় ভয়টা ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করে ফেলবে না তো। মনের মধ্যে ক'দিন ধরে একটা খটকা লাগতে শুরু হয়েছে ঐ আওয়াজটাকে নিয়ে।আমাকে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করার জন্য কেউ কোন ক্যামেরা লুকিয়ে রাখেনি তো আমার ঘরের মধ্যে।আজকাল বিজ্ঞানের যা উন্নতি তাতে হয়ত এ ক্যামেরার মাধ্যমেই ঠিক আমার কানের কাছে এ ফিসফিসে আওয়াজটা আসে। তা না হলে আমি কখন কি করছি একথা এ লোকটা জানবে কি করে।
চিন্তাটা মাথার মধ্যে আসার সাথে সাথে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত যেন নেমে গেল। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা, গলাটা শুকিয়ে গেছে। কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে মা আর দিদির উপর খুব রাগ হল। কেন জানি না মনে হতে লাগল এই সব কিছুর জন্য ওরাই দায়ী। ওরা কেন দায়ী হবে? কোথা থেকেই বা পাবে ক্যামেরা?কোন যুক্তি তর্কই বুঝতে মন চাইছিল না। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। মনের একটা অংশ বিদ্রোহ করছে মা আর দিদির বিরুদ্ধে আর আর একটা অংশ তখনও বলছে আরে তুই ভুল ভাবছিস এরকম হতেই পারে না। হঠাৎ চমক ভাঙল মায়ের ডাকে। দরজায় ঘা পড়ার শব্দ। মনের বিরক্তি চেপে রেখে দরজা খুললাম। মা নাকি অনেকক্ষণ ধরেই ডাকছে আমিই শুনতে পাইনি - মুখে কিছু না বললেও মনের সেই বিরোধী অংশটা যেন বলে উঠল বাজে কথা -দরজায় এতক্ষণ ধরে ডাকলে শুনতে পাব না কেন? সব সময় আমাকে কোনঠাসা করার চেষ্টা। খেতে বসে কারুর দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছিল না। বাবা বরাবরই চুপচাপ, নিজের মধ্যেই মগ্ন থাকে। ছোটবেলা থেকে আমার যত আদর ও আবদার সবকিছুই মা আর দিদির কাছে। বাবা চিরকালই পরিবারের একজন নির্বাক শ্রোতার ভূমিকা পালন করেছে।মাঝে মাঝে মাকে শুনেছি দিদির কাছে দুঃখ করতে বাবার এই চিরাচরিত উদাসীনতার জন্য। দিদির সাথে মায়ের খুব ভাল সম্পর্ক। আমার সাথেও তাই। কিন্ত কেন জানিনা গত কয়েকমাস ধরে আসি ওদের সাথে একটা অদ্ভুত দূরত্ব অনুভব করছি। ওরা হয়ত কিছুই বুঝতে পারছে না কিন্তু আমি কেমন আগের মত স্বতঃস্ফুর্ত হতে পারছি না। খাবার টেবিলে আমার ভাবান্তর মায়ের চোখ এড়িয়ে গেলেও দিদির চোখ এড়ায়নি। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর আমার নিজের কাছেই নেই -তার জবাব দিদিকে কি দেব? আজকাল আমার এই ভাবান্তর আমার দিদিকে বেশ ভাবিয়ে তোলে -একদিন শুনলাম মাকেও ও জিজ্ঞাসা করছে - মা যদিও ওর কথায় ততটা আমল দিচ্ছিল না।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আজকাল একা থাকতেই ইচ্ছা করেই মনের ভেতরটা সব সময় একটা দমচাপা ভাব। কারুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কম্পিউটারটা অন করতে গিয়েও করলাম না। জানলা দিয়ে সামনের স্কুলটা দেখা যায়। এই স্কুলেই কত আশা নিয়ে মা আমায় ভর্তি করেছিল–কিন্তু কি হল? নিজের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে করুণা হয়, কখনও বা আয়নায় নিজের ছবিটা মনে হয় আমাকে বিদ্রুপ করছে, বলছে প্রিয়, তুই জীবনে কিছুই করতে পারলি না -দেখ তোর বন্ধুরা তোকে ছাড়িয়ে কোথায় পৌঁছে গেছে-আর তুই সামান্য বি.এ. পাশ করে বেকার হয়ে ঘরের কড়িকাঠ গুনছিস। ফিসফিসানি আওয়াজটা যেন ওৎ পেতে থাকে যখনই আমার ভীষণ একা লাগে, হতাশ লাগে সেই সময় “ও” তাতে ইন্ধন দেয়। সেদিনকার ঘটনাটা এখনও আমার মনে আছে। আমি সচরাচর কোথাও যাই না, মার মতে আমি হচ্ছি গুড ফর নাথিং, কিন্তু সেদিন সিগারেট কিনতে বেরিয়েছি। কয়েকটা বাড়ির পরেই দোকানটা, বহু পুরোনো। হঠাৎ কানের ফিসফিসে আওয়াজটা আবার বলতে শুরু করল “আরে এই দোকানের সব জিনিস ভেজাল - দোকানীটা একটা চোর বহুদিন ধরে লোক ঠকাচ্ছে ওকে সকলের সামনে চেপে ধর দেখবি ও আসল কথা স্বীকার করবে। আমার মাথার ভাল দিকটা দপদপ করতে শুরু করেছে, মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড উত্তেজনা হচ্ছে - মন বলছে, প্রিয় এসব কিচ্ছু করতে যাস না বিপদে পড়বি, আর এ ফিসফিসানি আওয়াজ বলে চলছে বিপদ মানে ওর ভেজাল জিনিস এতগুলো লোকের শরীরে যাচ্ছে, সেটা বিপদ নয়। প্রিয় জিজ্ঞাসা কর ও তেলে ভেজাল মেশায় কিনা। ও সব দু'নন্বরী জিনিস রাখে কিনা? এখনও মনে আছে আমি ছুটতে শুরু করেছিলাম যতক্ষণ না বাড়ি পৌঁছাই। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এতক্ষণ ধরে একটানা লেখা বহুদিন অভ্যেস নেই, মাথার একটা দিকের শিরা দপদপ করছে, উঠে পড়ি।
মার্চ-১০, ২০০৯ :-
অনেকদিন পর আবার ডায়রীর পাতা খুলে বসেছি। আগে কতকিছু মনের মধ্যে আসত লেখবার জন্য আর আজ মাথাটা পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে। আজকাল কোন কিছু দু-তিন মিনিটের বেশী ভাল লাগে না।টিভি দেখতে বসে কতবার চ্যানেল চেঞ্জ করি। কোনটাই ইচ্ছে করে না মনোযোগ দিয়ে দেখতে। গল্পের বইও পড়তে ভাল লাগে না অথচ এটা আমার একটা হবি ছিল। মাঝে মাঝে নিজের ওপর খুব রাগ হয়। এক একসময় মনের মধ্যে একটা অদম্য ইচ্ছা জাগে আমার আশপাশের সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে। সেদিনকার ঘটনাটাই বলি। বাবা বাজারে গেছে, মা রান্নাঘরে, দিদি কলেজে পড়াতে গেছে। আমি কম্পিউটারে খুটখাট করছিলাম হঠাৎ করে মনের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত আতঙ্ক তৈরি হলো। মনে হতে লাগল আমার চারপাশে হাজারটা অদৃশ্য চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে ভাবলাম আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি নাকি। কিন্তু না! দিব্যি কম্পিউটারের সামনে বসে আছি। কম্পিউটারের স্ক্রীনে চোখ পড়তে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল, দুটো চোখ আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম আমি। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পর একটু স্থির লাগল নিজেকে । ভাবলাম কোন কারণে হয়ত মাথাটা গরম হয়ে গেছে। স্নান করবার জন্য শাওয়ারটা খুলেছি হঠাৎ শাওয়ারের জলের আওয়াজের মধ্যে থেকে সেই ফিসফিসানি গলার আওয়াজটা ভেসে এল- কি চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেলে, সব তোমার দিদির কারসাজী। তোমার চারিদিকে লুকানো ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে আর কম্পিউটারে wallpaper টা বদলে দিয়েছে __ তুমি খেয়ালই করনি।
কোনরকমে স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। এ সবের মানে কি,ও নিজে কলেজে পড়ায় আর আমি বেকার বলে ও আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করবে? গুম হয়ে বারান্দায় বসে দিদির ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
জুলাই-৫, ২০০৯ :-
বহুদিন ডায়রীতে হাত দেওয়া হয় নি। কারণ গত কয়েকমাস ধরে আমার উপর দিয়ে যে ঝড় রয়ে গেছে তাতে ডায়রী লেখার ইচ্ছা বা অবকাশ কোনটাই হয়নি। গত কয়েকমাস ধরে আমাকে ক্রমাগত একদল লোক ফলো করছে। টিভিতে আমরা যখন এ রকম দেখি তখন কিছুই বুঝি না যে কারুর সত্যিকারের জীবনে এ রকম হলে জীবন কতটা নরক হয়ে যায়। ব্যাপারটা যে কিভাবে ঘটল এখনো আমার কাছে তা পরিষ্কার না। সেদিন আর পাঁচটা দিনের মতই দেরী করে ঘুম থেকে উঠে মনটা বিরক্তিতে ভরে আছে, সেই সময় মা বলল বাজারে যেতে। আমি সাধারণত ঘরের এই সমস্ত কাজ কখনোই করি না কিন্তু বাবার শরীরটা ভাল ছিল না, অগত্যা চা খেয়ে বাজারের ব্যাগ হতে করে চললাম।
কিন্তু বাড়ির বাইরে পা দিয়েই হঠাৎ বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। সামনের চায়ের দোকানে বসা একটা ছেলের দল আমার দিকে তাকাল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ওরা নিজেদের মধ্যে আমাকে নিয়ে চোখাচোখি করল। দোকানটা পেরিয়ে কিছুদূর এগোবার পর মনে হতে লাগল কেউ বা কারা আমাকে ফলো করছে। বার বার পিছনে ফিরে তাকিয়েও কিছু কুল কিনারা করতে পারলাম না। এক অজানা ভয়ে মনের ভেতরটা কাঁপতে লাগল।
রাস্তার একটা বাঁক পেরিয়েছি হঠাৎ কেউ কানের কাছে বলে উঠল “ভয় করছে” সেই সাথে একটা অদ্ভুত বিদ্রুপ করা হাসি। আশে পাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। মনের ভুল ভেবে এগিয়ে বাজারে সবে ঢুকেছি হঠাৎ সেই ফিস্ফিসানি আওয়াজটা শুনতে পেলাম। এতদিন আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলত। আজকে অবাক হলাম আওয়াজটা আমার সাথে কথা বলছে না, কিন্তু একটু আগে ঐ শুনতে পাওয়া আওয়াজটার সাথে আমাকে নিয়ে কথা বলছে। একটা কথা তো বলতে ভুলেই গ্রেছি। গত কয়েকমাস ধরে এ ফিসফিসানি আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছিল। ইদানিং তো আমার প্রত্যেকটা কাজে কানের কাছে comment শুনতে পেতাম। কাজটা ভাল না মন্দ, এর পর কি করা উচিৎ ইত্যাদি। মাঝে মাঝে এত বিরক্ত লাগত যে কানে তুলো দিয়ে থাকতাম। বাজারের মধ্যে ঢুকেও অস্বস্তি হতে লাগল। মনে হচ্ছে আশপাশের দোকানীরা আমায় দেখে ফিসফিস করছে। নিজেদের মধ্যে ইশারা করছে। মনে হতে লাগল আমার পেছনে একটা বিরাট ষড়যন্ত্রের জাল পাতা হয়েছে, আর আমি কিছু না বুঝে গিনিপিগের মত একটু একটু করে শিকার হবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজার করে বাড়ি ফিরে এলাম। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর একটু স্বস্তি অনুভব করলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই, ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে।
ডিসেম্বর-১০, ২০০৯:-
গত কয়েক মাসে আমার জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা আমার জীবনের গতিতেই পাল্টে দিয়েছে। গত এক মাস বাড়ির বাইরে পা রাখিনি। কারোর সাথে আর নিজে থেকে কথা বলি না। কারণ সবাইকে আমার শত্রু মনে হয়। মাঝে মাঝে পুরো ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি কিন্তু পারি না। বাড়িতেও কারুর সাথে কথা বলতে গেলে মনের মধ্যে একরাশ বিরক্তি তৈরি হয়। মায়ের উপর মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠি-কেন জানি না মা, দিদি, বাবা কাউকে আর আমি বিশ্বাস করিনা। নিজেকে ভীষণ একা লাগে। রাত্রে ঘুম আসে না, নানা চিন্তা ভিড় করে আসে। নিজের জীবনটাকে সব দিক থেকে ব্যর্থ মনে হয়। দিদির বিয়ের কথা চলছে। খুব ভালো সম্বন্ধ আসছে। আমি পারতপক্ষে এসবের মধ্যে থাকি না। এমনকি জানতেও চাই না।
আমি বুঝতে পারি আমাকে নিয়ে মা আর দিদির চিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু আমার মধ্যে যে কি চলছে তা আমার কারোর কাছে বলতে ইচ্ছা হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বেঁচে থেকে কি লাভ। একটা বেকার ব্যর্থ জীবন। শুধু অন্যের ভারবোঝা। সারাদিন ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরোতে সাহস হয় না, মনে হয় বাড়ীর বাইরে পা দিলেই বোধহয় কেউ আমাকে খুন করে দেবে। মাকে একদিন এই কথাটা বলেছিলাম-মা সম্পূর্ণ ভাবে কথাটাকে উড়িয়ে দিলেও আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরী হয়ে গেছে, সেটা পাল্টাবার নয়।
ফেব্রুয়ারি-৭, ২০১০:-
কাল হসপিটাল থেকে বাড়ি এসেছি মাথায় ব্যথাটা এখনো পুরোদস্তুর আছে। ডাক্তার ছয় সপ্তাহ পরে রিপিট সিটিস্ক্যান করাতে বলেছে। সেদিনের কথাটা মনে পড়লে এখনো আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। আমার মনের অবস্থা গত এক বছর ধরে ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে। কানের কাছে ক্রমাগত আওয়াজগুলো বেড়ে চলছিল দিনে দিনে। মাঝে মাঝে অসহায় হয়ে আমি দেওয়ালে মাথা ঠুকতাম। কতবার ঘরের দরজা বন্ধ করে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কোন টেপ রেকর্ডার আছে কিনা, কিন্তু প্রতিবারই বিফল হয়েছি। অথচ কোথা থেকে যে এই আওয়াজ আসে, কেনই বা দিবারাত্র এই ফিসফিসে আওয়াজ আমাকে বিরক্ত করে তার কোনো কূলকিনারা পাই না আমি। মাঝে মাঝে মনে হতে থাকে আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। বাড়িতে মাকে বললে মা বিশ্বাস করতে চায় না বলে নাকি আমার মনের ভুল।
আমার অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছিল। বাড়ি থেকে বেরোনো পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। একটা নতুন উপসর্গের উদয় হয়েছিল গত কয়েক মাস ধরে। বাড়িতে যেহেতু কিছুই করবার নেই তাই আমার সময় কাটতো অলস ভাবে টিভি দেখে। কিন্তু সেদিন প্রথম একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে হতভম্ব হয়ে গেলাম। টিভিতে স্টার আনন্দে খবর দেখছি, হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো, যে মেয়েটি পড়ছে, সে আমাকে উদ্দেশ্য করে খবরটা পড়ছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং চোখে ইশারা করছে। যতবার চোখের ভুল বলে চোখ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম, ততই মনের মধ্যে ধারণাটা বদ্ধমূল হতে লাগল। শেষে বাধ্য হয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করলাম। সোনি ম্যাক্স-এ অমিতাভর একটা সিনেমা চলছিল।
পুরনো সিনেমা, আগে দেখা, কিন্তু হঠাৎ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে গা শিউরে উঠল। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম অমিতাভের অনেকগুলো ডায়ালগ আমাকে উদ্দেশ্য করেই। মনের ভেতরে প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগল। পাশেই বাবা বসে আছে। তিন-চার মাস আগে রিটায়ার করেছে। বাবা যদিও খবরের কাগজে মগ্ন। ভীষণ ইচ্ছে করলো চেঁচিয়ে ওঠে অমিতাভের উপর আমাকে নিয়ে এরকম তামাশা করার জন্য। ছুটে গিয়ে কাউকে সব কথা খুলে বলতে ইচ্ছা করল-কিন্তু কাকে বলবো কেউ বিশ্বাস করবে আমার কথা? সমস্ত পৃথিবী যেখানে আমাকে নিয়ে মজা করছে, বিদ্রুপ করছে, ষড়যন্ত্র করছে, সেখানে আমার কথা বিশ্বাস করবার মতো কেউ নেই, নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগলো, কিন্তু কাঁদার বদলে মনের মধ্যেটা প্রতিহিংসায় টগবগ করে ফুটতে লাগল। মনে হতে লাগল এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কেনই বা দিনের-পর-দিন আমার জীবনটা এই ভাবেই দুর্বিষহ হয়ে যাবে? বহুদিন পর বাড়ির বাইরে বেরোলাম। চায়ের দোকানের আড্ডাবাজ ছেলেগুলো একবার তাকালো আমার দিকে। ওদের অগ্রাহ্য করে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম অনেকগুলো চোখ আমার পেছনে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তিটা আবার মনের মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠলো। একটা মোড় পেরোতেই কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে লাগল, পিছন ফিরে দেখি বাবার বন্ধু সমরেশ কাকু আমাকে দেখে হাসছেন। কানের মধ্যে ফিসফিসানি আওয়াজটা বলে উঠল তুমি কষ্ট পাচ্ছ তাই দেখে মজা করছে, হাসছে। মনের বিরক্তি চেপে রেখে এগিয়ে গেলাম, সৌজন্যমূলক কথা না বললেই নয়, বলে তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে চললাম। একটা মোড় ঘুরতেই আর একটা চায়ের আড্ডা সামনে পড়লাম। হঠাৎ মাথার মধ্যেটা দপদপ করতে শুরু করলো। মনের সমস্ত হতাশা রাগে পরিণত হল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সামনে দেখা মাত্র ছেলে গুলো নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে, কেউ কেউ হাসছে। আর সহ্য হলো না এগিয়ে গিয়ে একজনের কলার ধরে জিজ্ঞাসা করলাম-আমাকে নিয়ে কি আলোচনা করছো? কানের মধ্যে আওয়াজ এলো এটাই দলের পান্ডা, এটাকে জব্দ করতে পারলেই এই অপমান থেকে মুক্তি পাবে তুমি। জোরে একটা চড় মারলাম ছেলেটাকে। ইতিমধ্যে দোকানের বাকী ছেলেরা আমার চারপাশে জড়ো হয়ে গেছে। চড় খেয়ে ছেলেটাকে কিছুটা হতভম্ব মনে হল। আমি কলারটাকে আরও শক্ত করে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এসব ক'দিন ধরে চলছে অন্যকে দেখিয়ে টিটকারি মারা, অন্যকে দেখে হাসাহাসি করা আর একদিন যদি এরকম দেখি মেরে দাঁত ভেঙে দেবো’। হঠাৎ করে মাথার পেছনে একটা আঘাত পেলাম-তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে। পরে শুনেছিলাম ওদের দলেরই একটা ছেলে আমার মাথায় মেরেছিল।
মার্চ-১৫, ২০২১ :-
মাথার আঘাতটার থেকেও মনের আঘাতটা বেশি। গত একমাস আমার মধ্যেটা সব সময় হাহাকার করে ওঠে, আর্তনাদ করে বলে, প্রিয় তুমি একটা failure person একটা looser। আজকাল একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখি মনের ভেতর এই যন্ত্রণা, হাহাকার যেন নিজের কানেও শুনতে পাই। ওই ফিসফিসানি আওয়াজটাও আমাকে সারাদিন ধরে আমার অক্ষমতার কথাগুলো বলতে থাকে। মাঝে মাঝে এই অপদার্থ, ব্যর্থ জীবন থেকে মুক্তির রাস্তাও বলে। কিন্তু আমি ভয় পাই। গত কয়দিন ধরে আওয়াজটা প্রতিনিয়ত একটা কথাই বলে চলেছে এই একঘেয়েমি থেকে বাঁচার একটাই উপায় আছে। বারবার কানের কাছে একই আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে, মনের গভীরে একটা মৃদু প্রতিবাদ মাথা তুলতে গিয়েও পারে না। মায়ের মুখটা বারবার ভেসে আসে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় আমার মত কোনো কাজে না লাগা একটা ভারবোঝা থেকে তো মা মুক্তি পাবে। হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। মনে হয় আমার এই নিরর্থক জীবনে কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু সবাইকে মুক্তি দিয়ে যাবো আমি আর সাথে সাথে আমিও পাব চির প্রশান্তি। নিমেষে মনের মধ্যেটা হালকা হয়ে যায়। অনেকদিনের টানাপোড়েনের পর হঠাৎ যেন সব বোঝা মাথা থেকে নেমে গেছে। হ্যাঁ, কালকে আসবে সেই মহালগ্ন, সবাই মুক্তি পাবে আমার থেকে আর আমিও পাব চিরশান্তি। ক্লান্তিতে দুচোখ জড়িয়ে আসছে। আজ বহুদিন পরে মনের ভেতরটা শান্ত লাগছে। যাই আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
মার্চ-১৬, ২০১০, রাত্রি ১১:৩০
অনেক ভেবেচিন্তে আমার এই ডায়রীর পাতাটাকেই ঠিক করলাম শেষ কথা লেখার জন্য। এখন মনের মধ্যে আর কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই।অনেকদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান যে এত তাড়াতাড়ি হবে ভাবি নি। আজ আমার কারুর ওপর ক্ষোভ নেই, দুঃখ নেই, রাগ নেই, নেই নিজেকে কোণঠাসা করার কোন ইচ্ছা। আজ আমি মুক্ত। সিলিং ফ্যানে দড়িটা টাঙ্গানো হয়ে গেছে। এবার শেষ কাজ গলায় ফাঁস লাগানো। বিদায়... আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

লেখিকা পরিচিতি
লেখিকা বিশিষ্ট স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবীক্ষণ।
Comments