রবীন্দ্রনাথ ও সমকাল
- Rabindramela Berhampore
- Oct 22, 2020
- 2 min read
বাসব মুখার্জ্জী

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দৈবীমহিমা একটা বড় অংশ জুড়ে আছে।সেখান থেকে যখন মানব-মানবীর আখ্যান এল তখন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিষয়টি স্কীকৃতি পেল।এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি তো আসলে আধুনিকতারই নামান্তর।পৌরাণিক চরিত্রগুলিকেও লোকায়ত পরিসরে আনা হয়।সাহিত্যের এই নবজাগরণ সংস্কৃতির অন্দরের কন্দরে সেঁদিয়ে যায়।আর তা ধীরে ধীরে মানসলোকের অন্তরেও প্রবেশ করতে থাকে।ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল'-এ পুরাণকাহিনির অলৌকিকতা লৌকিক জীবনের জলহাওয়ার আশ্রয়ে লালিত-পালিত।সেখান থেকে তার অভিযাত্রা ক্রমশ ডালপালা মেলেছে।দীর্ঘদিনের সংস্কার ভাঙার কাজ ততদিনে মহামনীষীরা শুরু করে দিয়েছেন।রবি ঠাকুরে এসে তার এক নবতর প্রকাশ,বিকাশ।সত্যিই সমাজের "অচলায়তন" ভেঙে "মুক্তধারা" বয়ে দিলেন তিনি।আর সেই বন্ধনমুক্তি আসলে চিন্তনের মননের।সেখানে বাহ্যিক আচারসর্বস্বতা নয়,আন্তরিক মুক্তমনা গতিধারা...সে যে মুক্তবিহঙ্গ ''বলাকা"..."রবি"-আকাশে "হেথা নয়,হেথা নয়" বলে "অন্য কোথা" এবং অন্য কোন খানে যাবার বাসনা তথা সেই উড়ন্ত ভঙ্গিমাই আসলে প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রকৃতঅর্থে আধুনিকতা।সেই আধুনিকতায় মিশেছে পুরাণ ইতিহাস সমাজ সব,অথবা অন্যকথায় এসবের নবভাষ্য রচিত হয়েছে...রবি ঠাকুর "আশা দিয়ে ভাষা দিয়ে" যে "মানসী-প্রতিমা"টি গড়ে তুললেন তা তাঁর সেই বিশিষ্ট আধুনিক চেতনার অভিজ্ঞান,তাতেই আমাদের মুক্তি,তাতেই আমাদের মোক্ষ...
...আর ধারাবাহিক এই বিকাশবিবর্তনের পথেই সমকালের অধিস্থান,সেই সমকালীন অবস্থানবিন্দুতেই মিলে যায় "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" নামক এক মহাসমুদ্রের উথালপাথাল ঢেউ...সেই স্রোত-প্রবাহে স্রোত-ধারায় অতীত-বর্তমান-আগামী সবই সেখানে একবিন্দুতে মিলে যায়।রবি ঠাকুরের উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক আর তাঁর অগণিত গানে 'স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ"-এর ভাবনা কথনে-চেতনে-মননে-মনে ঋদ্ধ করে আমাদের।তাঁর সৃষ্ট চরিত্রপাত্রগুলি তাৎপর্যবহ-তাৎপর্যপূর্ণ-তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে সেদিনের জলহাওয়ায় সৃজিত হয়ে সমসময়ের প্রেক্ষিতে-প্রেক্ষাপটে।মনে পড়ে 'ঘরে বাইরে' 'চার অধ্যায়' উপন্যাসগুলির কথা।এই উপন্যাসগুলিতে যে অস্থির সময়ের রেখাচিত্রটি আছে তা তো মিলে যায় আজকের যুগের গতিরেখার সঙ্গে।সন্দীপ-রা তো আজও সক্রিয়...বিমলাকে মাঝখানে রেখে নিখিলেশ আর সন্দীপের যে লড়াই দ্বন্দ্ব,রবি ঠাকুরের বিশিষ্ট "সীমা-অসীম"-এর তত্ত্বের আড়ালে আসলে যে তার মধ্যে সমকালীন বাস্তব যুগসংকটের চিত্রটিই ফুটে ওঠে।'চার অধ্যায়'-এর অতীন-এলা-র "প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস''-এ শুধু কি অনুরাগরঞ্জিত "সর্বনাশ"!তাতে যে ভয়ানক রাজনীতির করালস্রোত ঘূর্ণিপাকের ইশারা-ইঙ্গিত!এ যে সেদিনের হয়েও এদিনের!'চোখের বালি'র বিনোদিনী আর 'চতুরঙ্গ'-এর দামিনী কোথাও গিয়ে মিলে যায় একসাথে।আর তার সাথে যোগ দেয় 'যোগাযোগ'-এর কুমু,সেই দলের সদস্য হয় ''স্ত্রীর পত্র'-র মৃণাল ।ইতিহাস মিশে যায় বর্তমানকে ছুঁয়ে,ছুটে চলে মিলে যাবার জন্য ভবিষ্যতের পানে আগামীর দিকে...
...অন্যদিকে আবার 'রক্তকরবী'-র যক্ষপুরী-র আবহর সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যেতেই পারে সমসময়ের কর্কশ কঠিন কঠোর গুমোট আবহাওয়ার,আর সেখানেই তো মুক্তিকামী মানব-মানবী হিসেবে দেখা দেয় নন্দিনী আর রঞ্জনরা...নিষ্করুণ 'ক্ষুদিত পাষাণ'-এর পাগলা মেহের আলি "সব ঝুট হ্যায়" বলেছিল,আর 'রক্তকরবী'-র বিশু পাগলের উদাত্ত সুরধ্বনি "ঘুমভাঙানিয়া"র 'টোন' এবং 'টিউন'-এ যে জাগরণের আহ্বানধ্বনি তাতে তো এই "সুরে কাছে দূরে জলে স্হলে" যে বাঁশি বাজে,তা যে সমস্ত 'অচলায়তন'-কে ভেঙে দিয়ে অতীতচারিতা থেকে এইসময়ের ভূমি স্পর্শ করে ছুটে চলে আগামীর আগমনী-গীত শুনিয়ে..."ওই বুঝি বাঁশি বাজে" "বন-মাঝে" কিংবা "মন-মাঝে"!...আর সেই মন জুড়ে একটাই নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক সময়প্রবাহ সময়স্রোত : "রবি ঠাকুর"...

লেখক পরিচিতি
বাসব মুখার্জ্জী,রবীন্দ্রমেলার সদস্য।
Comments