top of page

রবীন্দ্রনাথের শৈশবকাল

  • Writer: Rabindramela Berhampore
    Rabindramela Berhampore
  • Aug 7, 2020
  • 4 min read

গার্গী মুখার্জী


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের মনের ঠাকুর, আমাদের প্রাণের ঠাকুর। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর রচনা শুধুই আমাদের প্রাণে সাড়া জাগায় তাইই নয়,তাঁর অপরিসীম সৃষ্টিসম্ভার আমাদের বিস্মিতও করে। তাঁর লেখনীর ঝরণা ধারায় স্নাত হয়নি এমন বাঙালি পাওয়া শুধু দুষ্করই নয় অসম্ভবও।কিন্তু কেমন ছিল এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোবেলা? কেমন ভাবে কেটেছে তাঁর শৈশব?

আমরা খুব সহজ ধারণা থেকে, বিশেষত সমকালীন কবিদের সাথে তুলনামূলক আলোচনায় হামেশায় বলে থাকি রবি ঠাকুর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন, এত বড় বাড়িতে তিনি জন্মেছেন তাই খুব সহজেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

কিন্তু আমরা যদি একটু তলিয়ে দেখি বা তাঁর শৈশবকে তাঁর লেখনী থেকে চিনি, তাহলে আমরা জানতে পারবো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবের একাকীত্ব, তাঁর নিঃসঙ্গতা, বিদ্যালয়ে শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি তাঁর অনীহার কারণ, আরও জানতে পারবো চাকরের সম্পূর্ণ দায়িত্বে মানুষ হওয়া শিশুর অসহায়তার কথা।

ছোটবেলায় দাদা ও ভাগিনেয় সত্যকে ইস্কুলে যেতে দেখে রবি কান্নাকাটি করে বাড়ির সকলকে বাধ্য করল ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে ভর্তি করতে, তখন তার এক গৃ্হশিক্ষক তাকে বলেছিলেন, "এখন ইস্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ, না যাবার জন্য ইহার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদিতে হইবে"। ভবিষ্যৎ-এ এই অমোঘ বাণীই ধ্রুব সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ওরিয়েন্টাল সেমিনারী সম্পর্কে পরবর্তীতে কবি তাঁর স্মৃতি থেকে শুধুমাত্র এটুকুই বলতে পারেন যে সেই ইস্কুলে ছাত্ররা পড়া বলতে না পারলে তাদের দুই হাত প্রসারিত করে হাতে অনেকগুলো স্লেট একসাথে চাপিয়ে দেওয়া হতো। পরবর্তীতে রবি নর্মাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। নর্মাল স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থাও রবির মনে বিশেষ ছাপ ফেলতে পারে নি। বরং সেখানে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে ছাত্ররা যে সুরের সাথে গলা মিলিয়ে কি গান করতো তা তারা নিজেরাও বুঝতো না, আর এলোমেলো কথা সাজিয়ে তারা যে প্রেয়ার করতো শিক্ষকরা কখনো তা শুধরে দেওয়ারও চেষ্টা করেন নি। এখান থেকেই তার বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনীহা তৈরি হয়।

বরং গৃ্হশিক্ষক সীতানাথ দত্তের কাছে যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রকৃতিবিজ্ঞান শিক্ষাতে রবি ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। সীতানাথ দত্তের শিক্ষাদানেই রবি প্রথম বিজ্ঞানের সব অদ্ভুত বিষয়ের প্রতি আগ্রহ অনুভব করে। উৎসুক হয়ে উঠেন যখন জলে কাঠের গুঁড়ো মিশিয়ে তা আগুনের উপর বসিয়ে দেখেন, জল গরম হলে কিভাবে উপরে উঠে যায় ভারী ঠান্ডা জলকে নিচে নেমে আসতে হয়। যে সপ্তাহে রবিবার সীতানাথ বাবু না আসতেন রবি মনে মনে অস্থিরতা অনুভব করতেন। এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে তার তীব্র অনীহা থাকলেও প্রকৃত শিক্ষা লাভের প্রতি ছোট্ট রবির ছিল গভীর আকর্ষণ।

ছোটবেলা ঠাকুর বাড়ির নিয়ম অনুসারে ছোট্ট রবির সম্পূর্ণ দায়িত্ব ভার ছিল চাকরদের হাতে।বাহির বাড়ির দোতলায় দক্ষিণপূর্ব কোণের ঘরে চাকরদের মহলেই তার দিন কাটতো। চাকরেরা তাদের দায়িত্ব কমানোর জন্য ছোট্ট রবির চারদিকে গন্ডি কেটে দিত এবং ভয় দেখাতো গন্ডির বাইরে গেলেই সমূহ বিপদ থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তাই নিরুপায় রবির ঘন্টার পর ঘন্টা কাটতো জানালার নিচে ঘাট বাঁধানো পুকুরের দিকে তাকিয়ে। ঘাট বাঁধানো পুকুর,চীনা বট গাছ, নারিকেল সারি সবকিছুকে একটা ছবির বই-এর মত করে সাজিয়ে প্রায় সমস্তদিন রবি কাটিয়ে দিত সেইদিকে তাকিয়ে। বিভিন্ন মানুষের অভিনব সব স্নানের পদ্ধতি, স্নানের পর বিড়বিড় করে মন্ত্র বলা, শুচিতার নিমিত্তে বিভিন্নদিকে জল ছেটানো, রাজহাঁস ও পাতিহাঁস গুলির গুগলি ধরার বিভিন্ন পদ্ধতি ও তাদের চঞ্চু দিয়ে পিঠ সাফ করার আশ্চর্য রকম উপায় এই সব দেখেই কাটতো রবির সারাদিনের অধিকাংশ সময়। পুকুর নির্জন হলে রবির সমস্ত মনকে অধিকার করে বসতো সেই বট গাছ তলাটি।

বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ ছিল, এমনকি বাড়ির ভিতরেও সব জায়গায় যাওয়া তাদের নিষেধ ছিল। যখন একটু বড় হল, দুপুরে সকলের ঘুমের সুযোগে এক একদিন ছাদে যাওয়ার সুযোগ হতো। সেখান থেকে প্রকৃতিকে দেখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চলতো, যতদূর দেখা যায় নারিকেল সারি, পল্লীর পুকুর, গোয়ালিনীর গোয়ালঘর, কলকাতা শহরের নানার আকারের উঁচুনিচু ছাদের শ্রেণি বিন্যাস, তার সাধ্যের বাইরে গিয়েও দেখার চেষ্টা চলত। পিতৃদেব যখন বাইরে যেতেন তখন তার তিনতলার ঘরের খড়খড়ি দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছিটকানি খুলে তাঁর সোফায় চুপচাপ শুয়ে বাইরের জগতকে দেখা ছিল তার শিশু মনের এক অদ্ভুত নেশা। আর এক আকর্ষণ ছিল পিতৃদেবের তিনতলার স্নান ঘরের জলের কল। ঝাঁঝরি খুলে দিয়ে অকালে মনের সুখে স্নান করাতেই ছিল অন্য এক মুক্তির স্বাদ। আনন্দ লাভের জন্য বাইরের উপকরণের প্রাচুর্য থাকলে অন্তরের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। তার রবির সে উপকরণ ছিল স্বল্প ও তুচ্ছ তাই জন্যই হয়তো তার আনন্দ লাভে কখনো ভাঁটা পরে নি।।

ছুটির দিন আর একটি জায়গা ছিল তার পছন্দের, গোলাবাড়ি। সেখানে খেলার থেকেও জায়গাটার প্রতি টানটাই ছিল তার বেশি। বাড়ির মধ্যে ছিল একটা বাগান, সেই বাগানের উত্তর কোণে ছিল একটি ঢেঁকিশাক, এই ছিল তার পছন্দের জায়গা। সে উৎসুক ছিল বীজে জল দিলে কি করে তার থেকে চারা বার হয় তা নিয়ে, কৌতুহলী ছিল পৃথিবীর মাটির নিচের পাতালপুরীর রহস্য নিয়ে, আকাশের বিশাল ব্যাপ্তি নিয়েও তার বিস্ময়ের শেষ ছিল না।

রবি ছোটো থেকেই ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে ছিল, কিন্তু কেমন ছিল সেই তত্ত্বাবধান? তিনি নিজেই পরবর্তীতে বলেছেন ভৃত্যরাজের শাসনকাল মোটেই সুখের ছিল না। তিনি বলেছেন "পিঠে যাহা পড়িত তাহা পিঠে করিয়াই লইতাম এবং মনে জানিতাম, সংসারের ধর্মই এই- বড়ো যে সে মারে, ছোটো যে সে মার খায়।" ভৃত্যরা শুধু যে মারতো তাই নয়, কোনো কারণে রবি কাঁদলে বড় বড় জলের জালার মধ্যে তাদের রোদনকে বিলুপ্ত করার চেষ্টাও চলতো। আসলে শিশুর সম্পূর্ণ ভার নিয়ে তারা শিশুটির শিশুসুলভ আচরণেই ছিল সবথেকে বেশি বিরক্ত। রবির বরাতে শাসন কর্তার কিল চড় তো হামেশাই জুটতো।

রবির শিশুকালে এক ভৃত্য ছিল যার নাম ঈশ্বর, সে ছিল অত্যধিক শুচিসঙ্গত ও আচারনিষ্ঠ, বিজ্ঞ স্বভাবের লোক। শুচিতা বজায় রাখতে ও বিচিত্র সাধু ভাষা বলতে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকতো, আর তার দুর্বলতা ছিল আফিমের প্রতি। আর আফিম খাওয়ার কারণে তার পুষ্টিকর খাবারেরও প্রয়োজন হতো। তাই রবিদের জন্য বরাদ্দ দুধের পাত্রটির প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রবল। জলখাবারের লুচিও পরিবেশিত হত শুচিতা বজায় রেখে, তবে দক্ষিণ হস্তের দাক্ষিণ্য তাতে প্রকাশ পেত না। এমন কি, তার জলখাবারের পয়সা থেকে পয়সা বাঁচানোর তাগিদে রবির ভাগ্যে জুটতো সস্তার মুড়ি, ছোলা সিদ্ধ, চিনাবাদাম ইত্যাদি।

বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহার কারণে বাড়িতেই শিক্ষা লাভের বিভিন্ন আয়োজন ছিল নিখুঁত।নর্মাল স্কুলের শিক্ষক নীলকমল ঘোষাল বাড়িতে পড়াতে আসতেন, ভোরবেলা এক কানা পালোয়ানের কাছে চলত কুস্তি শিক্ষা, স্কুল থেকে ফিরে আসতেন ড্রয়িং ও জিমনাস্টিক-এর মাস্টার, সন্ধ্যার সময় অঘোরবাবুর কাছে ইংরেজি পাঠ, হেরম্ব তত্ত্বরত্ন মহাশয়ের কাছে সংস্কৃত ও ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রের কাছে অস্থি বিষয়ক জ্ঞান লাভ, রবিবারে বিষ্ণু দের কাছে গান শেখা, তাছাড়া মাঝেমাঝে পাওয়া যেত সীতানাথ দত্তের সান্নিধ্য, যা ছিল শিশু রবির খুব আকাঙ্ক্ষিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবের একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা তাকে আরও প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। প্রকৃতিকে কখনো দূর থেকে কখনো বা কাছ থেকে পেয়ে প্রকৃতির সাথে গড়ে ওঠে রবির এক পরম আত্মিক সম্পর্ক, এক গভীর বন্ধন। আর এই কারণেই হয়তো বা আমরা তথা ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবী পেয়েছি আমাদের প্রাণের, মনের অন্তঃস্থলে বাস করা এই বিশ্ববরেণ্য কবিকে। তাঁর সেদিনের একাকীত্বের কারণেই হয়তো তিনি আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালো- মন্দের চির সঙ্গী, চির সখা হয়ে বেঁচে রয়েছেন আমাদের মাঝে যুগ যুগ ধরে।


লেখিকা পরিচিতি

গার্গী মুখার্জী, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page