
অনির্বাণ দাস
ওগো মৌন, না যদি কও
না-ই কহিলে কথা।
বক্ষ ভরি বইব আমি
তোমার নীরবতা।
স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে,
রজনী রয় যেমন করে
জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা
ধৈর্যে অবনতা। গীতাঞ্জলি-৭১
এই যে পরমেশ্বরের প্রতি আকুলতা, পরেও যা প্রকাশ পেয়েছে কবির জবানিতে, ‘এই বিশ্ব সংসারে এমন কিছুই নেই, একটি কণাও নেই যার মধ্যে পরমাত্মা ওতপ্রোত হয়ে না রয়েছেন কিন্তু তবু তিনি দ্রষ্টা—কিছুর দ্বারা তিনি অধিকৃত নয়। এই জগৎ তারই বটে তিনি এর সর্বত্রই আছেন বটে কিন্তু তবু তিনি এর অতীত হয়ে আছেন। আমাদের অন্তরাত্মাকেও সেই রকম করেই জানবে–সংসার তার, শরীর তার, বুদ্ধি তার, হৃদয় তার ;এই সংসারে, শরীরে, বুদ্ধিতে, হৃদয়ে তিনি পরিব্যাপ্ত হয়েই আছেন...’।শান্তিনিকেতন
কবি বলেছেন,
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও॥
নয়কো বনে, নয় বিজনে নয়কো আমার আপন মনে--
সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও॥ পূজা-৩৬৩
এই যে পৃথিবীর ধূলিমাটি আর গন্ধের সীমানা ছাড়িয়ে পরমাত্মার সঙ্গে বিলীন হবার যে ব্যাকুলতা রবিকবির লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে, সকল জাগতিকতার উর্ধে উঠে এই যে ব্যাকুলতা, সত্ত্বার পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ-এই তো সুফিয়ানা।
প্রায় সাতশ বছর আগে সুফি কবি রুমি তাঁর দিওয়ানে এমনই তো বলেছিলেন-
আর এই হল প্রেম-কথার পিঁজরা ছাড়িয়ে
সেই স্বর্গীয় বিহ্বলতা।
হঠাৎ প্রতিভাত হয় সন্ধানী সত্যের আলোকে,
নেই কোনো আবরণ, নেই আর পত্রাভরণ ইন্দ্রিয় তরে। (রফিক আব্দুল্লার ইংরাজী থেকে অনূদিত)
‘আমি কে?’ এ প্রশ্ন কবিকে যুবক বয়স থেকেই তাড়া করে বেড়িয়েছে।এই জিজ্ঞাসা সম্ভবত এসেছিল পিতার জীবনধারা থেকে। খুব ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় মহর্ষি যখন জোড়াসাঁকোতে ফিরে আসতেন, দিনমণি তখন দেখা দিচ্ছেন বা অস্তাচলে যেতে বসেছেন। আলোআঁধারির মায়াজালে দক্ষিণ বারান্দায় বসে শান্ত সমাহিত মহর্ষি হাফিজ-এর কবিতা আবৃত্তি করছেন। পিতার এই রাজসিক অবয়ব বালক রবির মনে প্রভাব ফেলেছিল,পিতার মুখে উচ্চারিত কাব্যের ভাষাও তাকে আপ্লুত করেছিল। অজানা সেই ভাষায় স্বরাঘাত আর অন্ত্যমিলের তরঙ্গ কবির অন্তরের সংবেদনশীলতাকে উদ্বেলিত করত।
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সুফি প্রভাব রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে মুক্ত হতে পারেনি।নৈবেদ্যতে কবি বললেন,
‘যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’
আর মরমী সুফি-সাধক হাফিজ অনেক আগেই প্রিয়তমের আহ্বানে বলেছেন,
আমার সকল ধ্যানে প্রিয়
বিচিত্র সে সুরে সুরে
গাহি তোমার বন্দনা গান
রাজাধিরাজ, নিখিল জুড়ে।
রবীন্দ্রনাথ হাফিজকে ধারণ করেছিলেন অন্তরে।নিজেকে হাফিজের পানশালার বন্ধু বলে মনে করতেন তিনি। তাঁর গজলে যে সুরের দ্যোতনা আছে প্রায় ঠিক সেই ঢঙেই লিখলেন তার গীতাঞ্জলির বেশ কিছু কবিতা। ১৯৩২ সালে হাফিজের সমাধিতে যাওয়ার জন্য পারস্যরাজের আমন্ত্রণ সাগ্রহে গ্রহণ করলেন। পারস্য যাত্রাকালে রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দেন, ‘এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’
মরুভূমির দেশ আরব। ভোগবিলাসী মানুষকে ফিরিয়ে আনতে একদল মানুষ শুরু করেন মরমিয়া ভাবধারা প্রচারের কাজ। তারা লম্বা জোব্বা পড়তেন বলে তাদের নাম হয়েছে সুফি। রবীন্দ্রনাথও কিন্তু সে রকম পোশাক পরতেন। সুফিবাদ হলো সমগ্র সঙ্গে প্রেম, তবে নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় সীমারেখায় তা বাধা পারেনি। জ্ঞানের অন্তহীন খোঁজই হলো তাদের ব্রত। কবিগুরুর ভাষায় ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।‘
সুফি সাধকরা মনে করেন, আল্লাহ্ এই দৃশ্যমান জগতে ব্যাপ্ত-সবকিছুর মধ্যে দিয়েই তিনি অবিরত নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন-দেখা বা না দেখার মধ্যে নেই কোন প্রভেদ। রবীন্দ্রনাথও ভাবলেন,
না বুঝেও আমি বুঝেছি তোমারে
কেমনে কিছু না জানি
অর্থের শেষ পাই না, তবুও
বুঝেছি তোমার বাণী। নৈবেদ্য
স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক কোন বিশেষ এক জায়গায় আবদ্ধ নয়-তা বিশ্বের সকল মাঝে প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে-তা অরূপ-
অরূপ বীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
সে বীণা আজি উঠিল বাজি' হৃদয়মাঝে॥
ভুবন আমার ভরিল সুরে,
ভেদ ঘুচে যায় নিকটে দূরে,
সেই রাগিণী লেগেছে আমার সকল কাজে॥ পূজা-৩৪৭
অসীমকে সীমার মাঝে খুঁজতে হয়।“বিশ্বের এই একত্ব ইন্দ্রিয়দ্বারা লাভ করা যায় না।। মানুষের কর্তব্য হলো সেই বহু ও বিচিত্রের মধ্যে মনন শক্তির সাহায্যে একত্ব উপলব্ধি করা।” এই সুফি ভাবনা থেকেই হাফিজের কাছে স্রষ্টা হলেন ‘প্রিয়তমা সাকী’ আর রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘অন্তরতমা মানস সুন্দরী’-যার আসনতলে ধূলায় ধুলায় মলিন হয়ে নিবেদন করেছেন সবকিছু-‘আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব’।রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে পরমাত্মাকে আহ্বান করেছেন,
ছিন্ন করে লও হে মোরে
আর বিলম্ব নয়
ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি
এই জাগে মোর ভয়।
এ ফুল তোমার মালার মাঝে
ঠাঁই পাবে কি, জানি না যে,
তবু তোমার আঘাতটি তার
ভাগ্যে যেন রয়।
ছিন্ন করো ছিন্ন করো
আর বিলম্ব নয়।
কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে,
আসবে আঁধার করে,
কখন তোমার পূজার বেলা
কাটবে অগোচরে।
যেটুকু এর রঙ ধরেছে,
গন্ধে সুধায় বুক ভরেছে,
তোমার সেবায় লও সেটুকু
থাকতে সুসময়।
ছিন্ন করো ছিন্ন করো
আর বিলম্ব নয়। গীতাঞ্জলি ৮৭
রবীন্দ্রনাথ ও সুফিবাদের আলোচনায় কে কাকে প্রভাবিত করেছেন সে ভাবনায় না গিয়ে, এটা বলা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুফিকবিদের ভাবনার যে মিল দেখা যায় তার ছাপ রবীন্দ্র কাব্য সাহিত্যের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। সাদী-রুমি-হাফিজ আর রবীন্দ্রনাথ মিলেমিশে যে অনন্য সাহিত্য পারাবার নির্মাণ করেছেন তা আমাদের ঋদ্ধ করে মননে ও যাপনে।সত্যসন্ধানী রবীন্দ্রনাথ সুফিভাবনাকে নিজের জীবনরসে জারিয়ে নিয়ে তাকে নিজের মতো করে তুলেছিলেন।তাই তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবনা সমকালীন ভারতীয় ঐতিহ্যের মতো হল না।সীমা-অসীমেরমাঝে মিলন ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথের সুফিয়ানা তাঁর নিজস্বতায় চিরভাস্বর।

লেখক পরিচিতি
অনির্বাণ দাস, রবীন্দ্রমেলার সদস্য
Bình luận