সুপর্ণা দাস মজুমদার

আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঋতু সৌন্দর্যের কবি।তাঁর ঋতু সাহিত্যে প্রকৃতি যেমন প্রতিভাত হয়, সেইরকম মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই। ঋতুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একদিকে দেখেছেন কঠিন-কঠোর রূপ তো অন্যদিকে দেখেছেন রস কোমলতা।অর্থাৎ গ্রীষ্মের মধ্যে একদিকে দেখেছেন এর রূদ্ররূপ, বৈরাগীর প্রলয়নাচন আর অপরদিকে মধুর স্নিগ্ধতা।
গ্রীষ্ম কবির কাছে ভোলানাথ শিবের মতোই কল্যাণের দূত। তাই কবি ধ্বংসের মধ্যেও শুনতে পান শান্তির কল্যাণমন্ত্র।
‘হে বৈরাগী, করে শান্তি পাঠ.
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে-
যাক নদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ। ‘
তবে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে গ্রীষ্মের স্বরূপ করেছেন তার পরিচয় রয়েছে ১৩০৬ সালে রচিত ‘বৈশাখ’ কবিতায়-
‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল, ’
তবে একটা ব্যাপার এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে কবিতায় বর্ষা, বসন্ত, শীত, হেমন্তকে সম্বোধন করেছেন, বর্ণনা করেছেন ঋতু নামেই, কিন্তু গ্রীষ্মের গানে কোথাও ‘গ্রীষ্ম’ বলে সম্বোধন নেই, সর্বত্রই তিনি বৈশাখ বলেছেন- মনে হয় ‘গ্রীষ্ম’ শব্দটি সম্ভবত তাঁর কাছে সুখশ্রাব্য ছিল না।তাই বৈশাখ শব্দের দ্বারাই তিনি গ্রীষ্মের অন্তঃস্বভাব পরিস্ফুট করেছেন। তবে তিনি গ্রীষ্মের প্রতি বিরূপ ছিলেন তারও প্রমাণ মেলেনি কিন্তু।
প্রখর তপ্ত বৈশাখ গ্রীষ্ম শুরুর প্রথম মাস। অবিরাম অগ্নিবাণে শুষ্ক শীর্ণ হয়ে ওঠে প্রকৃতির অবয়ব-চরাচর জুড়ে নিবিড় বৈরাগ্যের ছায়ামূর্তি, মুক্তির আকুতিতে উদ্দাম দিশেহারা। বাইরের লাবণ্যহীনতা চারদিকে ‘’নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা। খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা ॥”
দারুন দহনবেলায় ক্লান্ত কপোত খুঁজে বেড়ায় তৃষ্ণার জল। প্রকৃতিও তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে, ধরিত্রী বিদীর্ণ হয়ে যায়। তাপদাহে দহন শয়নে তপ্ত ধরণী পিপাসার্ত হয়ে বলে ওঠে-
‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্--
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্॥‘
গ্রীষ্ম বর্ণনায় কবি দারুন দহন বেলার রসহীনতার ছবি যেমন এঁকেছেন তেমনই বৈশাখী ঝড়কে জজীর্ণতার অবসানের নূতনের আবাহনের ভগীরথ রূপে বর্ণনা করেছেন-
‘ওই বুঝি কালবৈশাখী
সন্ধ্যা আকাশ দেয় ঢাকি’
শুষ্ক তাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে বলে ছুটে আসে কালবৈশাখী আর এর সঙ্গেই আসে বৃষ্টির আগমনী বার্তা। বিশ্বচরাচর অমৃতবারির পরশ পাওয়ার জন্য উদগ্র হয়ে ওঠে। তবে বৈশাখী ঝড় কেবল বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, আসে হৃদয়ের ভেতরেও। কবির কল্পনাচারী মন বলে
‘হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।
বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে॥‘
আর আমরাও কবির চোখের মাধ্যমে দেখি জটিল কেশে ঢাকা আকাশ, পিঙ্গল জটার দীপ্তি, কঠিনের ক্রুর বক্ষতল-
‘হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে
মন আজি মোর উদাস বিভোর কোন্ সে ভাবের বশে॥
তব পিঙ্গল জটা হানিছে দীপ্ত ছটা,
তব দৃষ্টির বহ্নিবৃষ্টি অন্তরে গিয়ে পশে॥
বুঝি না, কিছু না জানি
মর্মে আমার মৌন তোমার কী বলে রুদ্রবাণী।’

লেখিকা পরিচিতি
সুপর্ণা দাস মজুমদার, বহরমপুর রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।
Comments