ডঃ চন্দ্রানী সেনগুপ্ত

“মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে”-চারিদিক জুড়ে ঘন ঘোর বর্ষা-শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। শিলাইদহে পদ্মার বুকে ষ্টীমারের ছাদে রবীন্দ্রনাথ। বৃষ্টিধারায় সর্বাঙ্গ সিক্ত। ভরা বর্ষায় খরস্রোতা পদ্মার উপর দিয়ে কাঁচা ধানে বোঝাই নৌকায় চাষীরা পারাপার করছিল, সেইদিনই কবির মনে ‘সোনার তরী’ কবিতার ভাবনার সঞ্চার হয়েছিল, যা পরে ভাষায় প্রকাশ পায়-‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা…’।
রবীন্দ্রনাথের অলোকসামান্য দীর্ঘ জীবন শুধু ব্যাপ্তিতে নয়, বৈচিত্র্যেও অনন্যোপম।সব ঋতুই ছিল কবির কাছে প্রিয় তবে বর্ষার প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল নিঃসংশয়ে বেশি। সব ঋতুর মধ্যে তিনি বর্ষার গান সবচেয়ে বেশী লিখেছিলেন। গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ে গানের সংখ্যা ২৮৩, তারমধ্যে কেবল বর্ষা পর্যায়েই তাঁর গানের সংখ্যা ১২০টির মতো। বর্ষা ঋতুর প্রতি তাঁর এই বিশেষ অনুরাগের কারণটা কি? তার কারণ হল-‘বর্ষা ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু’-এটা রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন।এক্ষেত্রে গীতার উপদেশকেও কবি অতিক্রম করে যান-তাঁর কথায়, ‘তাহার কর্মে ও অধিকার নাই, ফলেও অধিকার নাই’-তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে- কর্ম হইতে ছুটি, ফল হইতে ছুটি। বর্ষা ঋতুটাতে ফলের চেষ্টা অল্প এবং বর্ষায় সমস্ত ব্যবস্থা কর্মের প্রতিকূল-এইজন্যই বর্ষায় হৃদয়টা ছাড়া পায়।যখন
“ঝরে ঘন ধারা নবপল্লবে,
কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে,
তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে এল পল্লীর কাছে রে।”-
তখন কবি গলা খুলে দুটি হাত শূন্যে তুলে উদাত্ত কন্ঠে বলতে পারেন- “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।।”
কবির জীবনস্মৃতি কাব্যগ্রন্থ থেকে জানতে পারি-কোন বালক বয়স থেকে বর্ষার সংগে তাঁর ছিল নিবিড় হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক। বর্ষার আবির্ভাবে তাঁর মনের ভিতরটা ‘কদম্বফুলের মতো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত’।
কবির বয়স তখন পনেরো, তখন হঠাৎ একদিন দুপুরে আকাশের ঘন শ্যামল মেঘ তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিল-বর্ষার কবিতা লিখতে।
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কবিতা যদি বিষয়বস্তু অনুসারে সাজানো যায় তাহলে, দেখা যাবে বর্ষার কবিতার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
কখনও শান্তিনিকেতনে বর্ষা, কখনও শিলাইদহে বর্ষা কবিকে আবেগে আপ্লুত করে তুলত। আকাশ জুড়ে মেঘ ও রৌদ্রের খেলায় কবি বিমুগ্ধ হতেন। তাঁর হৃদয়বীণার সুর নবচঞ্চল ছন্দে বেজে উঠত-প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের তরঙ্গ দেখে বিস্মিত হতেন কবি।
কবি নিজেই বলেছেন-“তাঁর মনের গতিক আকাশের গতিকের মতো-কিছুই বলা যায় না”।কথাটা নিজের সম্বন্ধে কবি সবটুকুই ঠিক বলেছিলেন। কবি তাঁর নিজের মন নিজেই বুঝতেন না-কখনও আকাশে মেঘ দেখে কাজ থেকে ছুটি চান, আবার কখনওবা বৃষ্টিধারার সংগে তাল মিলিয়ে ইচ্ছা করত কবিতা লিখতে, পদ্যে পত্র লিখতে আবার কখনওবা কানাড়া অথবা মল্লারে গলা ছেড়ে গান গাইতে।
ঋতুকেও যে সাদরে বরণ করে উৎসব হতে পারে- এই বঙ্গদেশে তারও প্রবর্তনের মূলে রবীন্দ্রনাথই।নাটক নয়, নৃত্য নয়-শুধু গান দিয়ে আসর বসিয়ে শুরু হল ঋতু উৎসব ‘বর্ষামঙ্গল’। সেটা ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, ১৯২১ সাল।প্রথমে শান্তিনিকেতনে এবং কদিন পর কলকাতায় জোড়াসাঁকো বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রথম বর্ষামঙ্গল উৎসব অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে।
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমারের অভিমত এই বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান প্রবর্তনের মধ্য দিয়েই ‘রবীন্দ্রসংগীতের জলসার সূত্রপাত’।
প্রথম জীবনে বর্ষার রিমঝিম রূপ দেখে কবি যতই উদাস, ভাবুক এবং আনমনা হোন না কেন, শেষ বয়সে এই বর্ষাই তাঁকে ভীষণভাবে কর্মব্যস্ত করে তোলে-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান।একটা অনুষ্ঠানকে কিভাবে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে হয়, সে ব্যাপারে সকলের আদর্শ হতে পারেন শুধু রবীন্দ্রনাথ-তাঁকে নিয়ে চর্চা করার অর্থ নিজেকে সমৃদ্ধ করার পথ খুঁজে পাওয়া।রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে অমোঘ আধুনিকতা। তাই তিনি আজও প্রাসঙ্গিক।একথা সত্য, বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথকে নবতর দৃষ্টিকোণে উপস্থাপন করা সহজ নয়।
পরিশেষে বলি-সংক্ষেপে এই মানুষটির ব্যাখ্যা যদি করা যেত, তাহলে ওনাকে নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাবো কি করে? তাও বলি গানে গানে-
“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার”-
প্রণাম কবি।

লেখিকা পরিচিতি
ডঃ চন্দ্রানী সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা, ও প্রাক্তন সম্পাদিকা।
Comments