রাখী তপাদার

শৈশব থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তাঁর কাব্যে, সংগীতে প্রকৃতি প্রেমের উজ্জ্বল ছবি অঙ্কিত হয়েছে। নিসর্গ চেতনাকে কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রসোত্তীর্ণ করেছে।
আত্ম পরিচয়ে কবি বলেছেন, ‘বাল্যকাল থেকে অতি নিবিড়ভাবে আনন্দ পেয়েছি বিশ্বদৃশ্যে।’ কবি ‘জীবনস্মৃতি’তে উল্লেখ করেছেন, ‘বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল। সেইজন্য বিশ্ব প্রকৃতিকে আড়াল আবডাল হইতে দেখিতাম।’ পদ্মার তীর, শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পটভূমি- আম্রকুঞ্জ, মাধবীকুঞ্জ, শালবীথি ঋতু পরিবর্তনে যে নব নব রূপ পরিগ্রহ করত তা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি।
‘প্রকৃতির পরিশোধ’ অপরূপ আলেখ্য, ‘আমি যে সময়কার কথা বলিতেছি সে সময়ের দিকে তাকাইলে দেখিতে পাই তখন শরৎ ঋতু সিংহাসন অধিকার করিয়া বসিয়াছে। তখনকার জীবনটা আশ্বিনের একটা বিস্তীর্ণ স্বচ্ছ অবকাশের মাঝখানে দেখা যায়- সেই শিশিরে ঝলমল করা সরষে সবুজের উপর সোনা গলানো রৌদ্রের মধ্যে মনে পড়িতেছে- দক্ষিণের বারান্দায় গান বাঁধিয়া তাহাতে যোগিয়া সুর লাগাইয়া গুনগুন করিয়া গাহিয়া বেড়াইতেছি।... সেই শরতের সকালবেলায়-
‘আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে
কী জানি পরান কী যে চায়।’
বেলা বাড়িয়া চলিতেছে।বাড়ির ঘণ্টার দুপুর বাজিয়া গেল, একটা মধ্যাহ্নের গানের আবেশে সমস্ত মনটা মাতিয়া আছে। কাজকর্মের কোনো দাবিতে কিছুমাত্র কাণ দিতেছি না, সেও শরতের দিনে-
‘ হেলাফেলা সারাবেলা
এ কী খেলা আপন মনে।’
কবি বলেছেন-‘ জানি না কেন আমার তখনকার জীবনের দিনগুলিকে যে আকাশ যে আলোকের মধ্যে দেখিতে পাইতেছি তাহা এই শরতের আকাশ, শরতের আলোক। সে যেমন চাষিদের ধান পাকানো শরৎ, তেমনি সে আমার গান পাকানো শরৎ- সে আমার সমস্ত দিনের আলোকময় অবকাশের গোলা বোঝাই করা শরৎ-আমার বন্ধনহীন মনের মধ্যে অকারণ পুলকে ছবি আঁকানো গল্প বানানো শরৎ।’
‘শারদোৎসবে’ কবি বলছেন, ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের উৎসব ঘরে ঘরে বারে বারে ঘটিতেছে কিন্তু প্রকৃতির সভায় ঋতু উৎসবের নিমন্ত্রণ যখন গ্রহণ করি তখন আমাদের মিলন অনেক বড়ো হইয়া উঠে।
নব ঋতুর অভ্যুদয়ে যখন সমস্ত জগৎ নূতন রঙের উত্তরীয় পরিয়া চারিদিক হইতে সাড়া দিতে থাকে, তখন মানুষের হৃদয়কেও সে আহ্বান করে –সেই হৃদয়ে যদি কোনো রঙ না লাগে, কোনো গান না জাগিয়া উঠে, তাহা হইলে মানুষ সমস্ত জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকে।
“ভানু সিংহের পত্রাবলী”তে প্রকাশিত একটি চিঠিতে কবি শারদোৎসব সম্বন্ধে লিখছেন- ওটা হচ্ছে ছুটির নাটক। অর সময়ও ছুটির । রাজা ছুটি নিয়েছেন রাজত্ব থেকে, ছেলেরা ছুটি নিয়েছে পাঠশালা থেকে। তাদের আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই কেবল একমাত্র হচ্ছে
‘বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সকল বেলা।‘
শরৎ মানেই বাঙালীর দুর্গাপুজো; সেই উৎসব ঘিরে পুজোর ছুটি। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘ছুটির আয়োজন’ কবিতায় লিখেছেন-
‘ কাছে এল পুজোর ছুটি
রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রঙ
হাওয়া উঠেছে শিশিরে শিরশিরিয়ে
শিউলির গন্ধ এসে লাগে,
যেন কার ঠাণ্ডা হাতের কোমল সেবা।‘
তাঁর ‘শেষ সপ্তক’ কাব্যগ্রন্থের তেইশ সংখ্যক কবিতায় –
‘আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি
মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা
আমি দেখলেম নবীনকে ... ।’
‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের পনের সংখ্যক কবিতায় শরতের সেই রূপই অঙ্কিত হয়েছে-
‘চন্দন তিলক ভালে
শরৎ উঠিল হেসে চমকিত গগন প্রাঙ্গণে
পল্লবে পল্লবে কাঁপি
বনলক্ষ্মী কিঙ্কিনী কঙ্কণে
বিচ্ছুরিল দিকে দিকে জ্যোতিষ্কণা।‘
শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণ রাঙা চরণ ফেলে শারদলক্ষ্মীর আবির্ভাব, কবির আবাহন-
‘এসো গো শারদলক্ষ্মী
তোমার শুভ্র মেঘের রথে
এসো নির্মল নীল পথে
এসো ধৌত শ্যামল
আলো ঝলমল
বন গিরি পর্বতে।‘
শরৎরাণীর আঁচলখানি কাঁপতে থাকে মৃদু মন্দ হাওয়ায়। নয়ন ভুলানো রূপ দেখে বিমুগ্ধ কবি গেয়ে ওঠেন -
‘তোমার মোহন রূপে
কে রয় ভুলে
শরৎ আলোর আঁচল টুটে
কিসের ঝলক নেচে উঠে
ঝড় এনেছ এলোচুলে।’
কবির সাথে তাই আমরাও বলি-
‘প্রফুল্ল শেফালিকুঞ্জ যার
পায়ে ঢালিছে অঞ্জলি,
কাশের মঞ্জরি রাশি যার পানে উঠিছে চঞ্চলি-
স্বর্ণদীপ্তি আশ্বিনের স্নিগ্ধ হাস্যে সেই রসময়
নির্মল শারদরূপে কেড়ে নিল সবার হৃদয়।‘

লেখিকা পরিচিতি
রাখী তপাদার, রবীন্দ্রমেলার সদস্যা।

Comments