top of page

শারদোৎসব

অনামিকা দত্ত



এ বছর তো উলটপালট এর বছর, তাই এ বছরের আশ্বিন মাস মলমাস হওয়ার কারণে এবার অকালবোধন আর আশ্বিনে হবে না, হবে কার্তিকে | অর্থাৎ, এবার মা উমার মর্তে আগমন বা বাপের বাড়ি আসা আর শারোদৎসব নয় বরং হেমন্ত-উৎসব |

আজ আমার আলোচ্য বিষয় “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শারোদৎসব” | সুহৃদ পাঠকগণ, আপনারা সকলেই জানেন যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাঙ্গালীদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের সাথে এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, দুঃখ-কষ্ট, ভাব-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া, এমনকি জন্ম-মৃত্যু সহ সব কিছুই রবীন্দ্র ভাবে আবিষ্ট, ফলে শুধুমাত্র শারদ উৎসবের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ করে কোনো আলোচনা বোধহয় সম্ভব নয় |

বঙ্গাব্দ তেরোশো পনেরোঅর্থাৎ 1908 খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু স্বয়ং একটি ‘শারদোৎসব’ নামক প্রহসন ধর্মী নাটিকা সংকলন করেন | সেখানে সন্ন্যাসীর বেশে রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্য রাজ্য ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন | সন্ন্যাসীর বেশে সমস্ত স্তরে প্রজাদের মধ্যে মিলে মিশে তিনি খোঁজখবর সংগ্রহ করতে বেরোন | বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে নিতান্তই সাধারণ ভাবে মেলামেশার মাধ্যমে তিনি জীবনের মূলমন্ত্র সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা অর্জন করেন | এমন সময় তার অধীনস্থ এক রাজা সুরপাল,রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্য-এর সাম্রাজ্য দখলের পরিকল্পনা করছিলেন | রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্য সে কথা জানতে পেরে যান |

এদিকে সন্ন্যাসীর কথা গোটা দেশে মুখে মুখে প্রচার হয়ে গেছে | সন্ন্যাসীর তখন বেশ নামডাক | রাজা সুরপাল ভাবলেন রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্য-এর সাম্রাজ্য দখলের আগে একবার সন্ন্যাসীর আশীর্বাদ নেওয়া প্রয়োজন | তাই রাজা সুরপাল চললেন সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে | দুজনের দেখা হতেই রাজা সুরপাল চিনে ফেললেন রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্যকে | বুঝতে পারলেন সন্ন্যাসীর বেশে রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্যর রাজ্য ভ্রমণের কি অভিপ্রায় | তখন আর কথা না বাড়িয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্যর কাছে আত্মসমর্পণ করে জানতে চাইলেন, কি করলে, রাজত্ব করার উপযুক্ত হতে পারবেন? সন্ন্যাসীবেশে রাজাধিরাজ সম্রাট বিজয়াদিত্য মহারাজ বললেন, উপদেশটি কথায় খুব ছোট কিন্তু কাজে অত্যন্ত বড়|“রাজা হতে গেলে,প্রথমে সন্ন্যাসী হওয়া চাই” |

কবিগুরুর ‘শারদোৎসব’ নামক প্রহসন ধর্মী ঐ নাটিকায় সেই অর্থে বাঙালির শারদ-উৎসব অর্থাৎ দুর্গাপূজা নিয়ে কিন্তু কিছু বলা নেই| কিন্তু সমগ্র নাটিকাটির নিগূঢ় অর্থ, নিশ্চয়ই হ’লো এই, যে, যে কোনো বৃহত উদ্যোগ অথবা মহৎ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের প্রারম্ভিক সূচনার উৎসবকেই বলা হয় শারদ-উৎসব| মানে যে কোনো শুভ উদ্যোগের শুভ সূচনার উৎসবই হ’লো-- শারদ-উৎসব|

এর বাইরে রবীন্দ্র সাহিত্যে বিস্তারিতভাবে দুর্গোৎসবের তেমন বিবরণ কিন্তু কোথাও তেমন পাওয়া যায় না যদিও শারদ কাল বা শরতের কথা বারংবার উঠে এসেছে তার গান, গল্প, কবিতা কিংবা প্রবন্ধে| তার শরত্কাল কিম্বা শারদেরএইসকল রচনাতে মুখ্যত তিনটে বিষয় আলোচিত হয়েছে বারবার| এক শরতকালের প্রকৃতি,দুইশরৎকাল অর্থাৎ ছুটি আর তিন,শরৎকাল অর্থাৎ ভ্রমণ |সমস্ত বাঁধন ছিন্ন করে অনাবিল আনন্দের অনিশ্চিত ঠিকানায় ভ্রমণ|

কবি রচিত বাংলা ঋতু সম্পর্কিত গীতি আলেখ্য ‘নটরাজ’ কাব্যগ্রন্থের ‘শরৎ’ কবিতায়, কবি লিখছেন--

ওরে, শারদার জয়মন্ত্রের গুণে

বীর-গৌরবে পার হতে হবে সাগরে

ইন্দ্রের শর ভরি নিতে হবে তূণে

রাক্ষসপুরীর জিনে নিতে হবে, জাগো রে |

দেবী শারদার যে প্রসাদ শিরে লয়ি

দেব-সেনাপতি কুমার দৈত্যজয়ী

সে প্রসাদখানি দাও গো অমৃতময়ী,

এই মহাবর চরণে তাঁহার মাগো রে ||

এছাড়া সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে, সেই অর্থে শারদ উৎসবের আর তেমন কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ পাই না |

অথচ শরৎকাল বা শরৎ-এর বিবরণ রয়েছে ছত্রে ছত্রে | তাঁর নাটিকা ‘শারদোৎসব’-এর শুরুতেই প্রথম কবিতাটি হ’ল--

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি,

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি |

কবির ‘বীথিকা’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কবিতা ‘আশ্বিন’-এ ‘শরৎকাল’ সম্বন্ধে কবি লিখছেন,

ঘাসে ঝ’রে পড়া শিউলির সৌরভে

মন-কেমনের বেদনা বাতাসে লাগে |

মালতী বিতানে শালিকের কলরবে

কাজ-ছাড়া-পাওয়া ছুটির আভাস জাগে |

১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সাল, দীর্ঘ ৬ বৎসর ব্যাপী, কবি তাঁর লেখালেখির মধ্যে দিয়ে ‘ছন্দ’ সম্পর্কে ‘ছন্দ’ নামক একটি অতি সমৃদ্ধ প্রবন্ধ রচনা করেন | সেখানে শরতের বিবরণে তিনি লিখলেন--

শরতে শিশির বাতাস লেগে জল ভ’রে আসে উদাসী মেঘে |

বরষন তবু হয় না কেন, ব্যথা নিয়ে চেয়ে রয়েছে যেন |

কবির ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ৩৮-তম গানে তিনি লিখেছেন--

নীল আকাশের নীরব কথা শিশির ভেজা ব্যাকুলতা

বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে |

শস্যক্ষেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে

ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অনল জলধারে |

আর ‘সহজ পাঠ’-এর প্রথম খন্ডে, যে কবিতাটি প’ড়ে আমরা বাংলা ভাষার কিছুটা শিখেছি, সেই ‘শরৎ’ কবিতাটি বোধহয় এক সঙ্গে সমস্ত ভাবনাকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে |

এসেছে শরৎ, হিমের পরশ

লেগেছে হাওয়ার ‘পরে--

সকালবেলায় ঘাসের আগায়

শিশিরের রেখা ধরে |

আমলকি-বন কাঁপে, যেন তার

বুক করে দুরু দুরু--

পেয়েছে খবর পাতা-খসানোর

সময় হয়েছে শুরু |

শিউলির ডালে কুঁড়ি ভ’রে এল,

টগর ফুটিল মেলা,

মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায়

মৌমাছি দুই বেলা |

গগনে গগনে বর্ষণ-শেষে

মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া,

বাতাসে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে,

নাই কোনো কাজে তাড়া |

দিঘী-ভরা জল করে ঢল্-ঢল্

নানা ফুল ধারে ধারে,

কচি ধানগাছে ক্ষেত ভ’রে আছে--

হাওয়া দোলা দেয় তারে|

যে দিকে তাকাই সোনার আলোয়

দেখি-যে ছুটির ছবি,

পুজার ফুলের বনে ওঠে ওই

পূজার দিনের রবি |

যে কথা বলছিলাম শরৎ মানে কবির কাছে-- ‘প্রকৃতি’, ‘ছুটি’ এবং ‘ভ্রমণ’ বা বাঁধনহারা মুক্তি | তাই ফটিক কে নিয়ে ‘ছুটি’ গল্পটি সমস্ত কিশোর-কিশোরীদের চিরন্তন ভাবাবেগ-এর নিদারুণ বাস্তব চিত্রায়ন | কিন্তু ‘ছুটি’ গল্প ছাড়াও কবির বিভিন্ন রচনার ছত্রে ছত্রে ছুটি নিয়ে কবির গভীর আকুতি প্রকাশ পায় |

‘বিথীকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘আশ্বিন’ কবিতায়, তিনি লিখছেন--”কাজ-ছাড়া-পাওয়া ছুটির আভাস জাগে” |

‘শরতের প্রবেশ’ গানে লিখছেন--

শরৎ আজি শুভ্র আলোকেতে

মন্ত্র দিল পড়ে,

ভুবন তাই শুনিল কান পেতে

বাজে ছুটির ঘড়ি |

কাশের বনে হাসির লহরীতে

বাজিলো ছুটি মর্মরিত গীতে--

ছুটির ধ্বনী আনিল মোর চিতে

পথিক বন্ধুরে |

আর ‘শারদোৎসব’ নাটিকার প্রথম কবিতা তেই, আগেই বলেছি,

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি,

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি |

আর ছুটি মানেই তো মুক্তি, সমস্ত বাঁধন থেকে মুক্তি, তাই সমস্ত বাঁধনকে ছিন্ন ক’রে বিশ্বনিখিলে, আকাশে-বাতাসে নিজেকে হারিয়ে দেওয়া ছাড়া ছুটির পূর্ণতা কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না |

তা সেই ছুটি ভ্রমণ হোক অথবা তীর্থ কিংবা কোনো অচিনপুরে হারিয়ে যাওয়া; বিষয়টা মূলত একই | তাই ‘শারদোৎসব’ নাটিকায় কবি বলছেন--

কি করি আজ ভেবে না পাই,

পথ হারিয়ে কোন বনে যাই,

কোন মাঠে যে ছুটে বেড়ায়

সকল ছেলে জুটি |

কেয়া পাতার নৌকা গ’ড়ে

সাজিয়ে দেব ফুলে

তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেবো--

চলবে দুলে দুলে |

রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু

আজ চরাব বাজিয়ে বেণু

মাখবো গায় ফুলের রেণু

চাঁপার বনে লুটি |

‘শরতের প্রবেশ’ গানে কবি লিখছেন--

শরৎ ডাকে ঘর ছাড়ানো ডাকা

কাজ ভুলানো সুরে

চপল করে হাঁসের দুটি পাখা

ওড়ায় তারে দূরে |

পথের বাণী পাগল করে তাকে,

ধুলায় পড়ে ঝুরে

শরৎ ডাকে ঘর-ছাড়ানো ডাকা

কাজ খোওয়ানো সুরে |

কাশের বনে হাসির লহরীতে

বাজিলো ছুটি মর্মরিত গীতে--

ছুটির ধ্বনি আনিল রে মোর চিতে

পথিক বন্ধু রে |

শরৎ ডাকে ঘর-ছাড়ানো ডাকা

কাজ খোওয়ানো সুরে |

কবি বাঙালির মনে, ঘর ছেড়ে, পায়ের তলায় সরষে দানা দিয়ে, বহিরজগতের অনিশ্চিত অচিনপুরে পাড়ি দেওয়ার যে নেশা ধরিয়েছেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় কবির রচনা ‘পুরাতন ভৃত্য’ | সেখানে তিনি লিখছেন--

সে বছরে ফাঁকা, পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি,

করিলাম মন, শ্রী বৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি |

সুতরাং আমাদের কবিগুরুকে শুধুমাত্র ‘শারদোৎসব’-এ সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়| তিনি সর্বাঙ্গীণ, সার্বজনীন, আমাদের শয়নে-স্বপনে, জাগরণে, চেতনায় সদা বিরাজমান |তাই তাঁকে উপলক্ষ করে আজ আমাদের উৎসব, আজ আমাদের আনন্দ, আজ আমাদের ছুটি এবং আজ আমাদের অনাবিল আনন্দের অনিশ্চিত ঠিকানায় হারিয়ে যাওয়া| কারণ, আজ আমাদের ‘শারদোৎসব’ |


লেখিকা পরিচিতি

অনামিকা দত্ত, অধ্যক্ষা

সেন্ট স্টেফেন’স আইকোনিক স্কুল

নূতনগ্রাম, লালবাগ, মুর্শিদাবাদ

Comments


m4nPNpRzn2BaiWQu_7.jpg

© 2023 by Train of Thoughts. Proudly created with Wix.com

bottom of page